জয়ীতা চট্টোপাধ্যায়: ‘পুজো আসছে’ – এই শব্দ দুটোর মধ্যে একটা অদ্ভুত আন্তরিক টান আছে। সেই টানেই বাঁধা পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আপামর বাঙালি তথা উৎসবপ্রিয় মানুষ। থেমে গিয়েছে বর্ষার ঘনঘটা! দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশে উঁকি দিচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের সারি। একদিকে কাশফুলের দোলা, অন্যদিকে শিউলি ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা এই জগৎ। পৃথিবীর যে কোনায় আপনি থাকুন না কেন, অজানা এক আনন্দের ঢেউ দোলা দেবেই। দেশ–কাল–সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে সূর্যাস্তের অন্য ‘ঘাটে’ – ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
কর্মসূত্রে প্রায় আড়াই বছর ধরে দেশছাড়া। এই অল্প সময়কালের মধ্যে কোপেনহেগেন আর হামবুর্গ – ইউরোপের এই দুটি শহরে দুর্গাপূজা উদযাপনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। বলা বাহুল্য, ঘর থেকে বহুদূরে এক টুকরো পুজোর আমেজ পেতে ছিন্নমূল বাঙালি যে ভীষণ রকম টান অনুভব করে, তা দুই দেশে একই রকম। কোপেনহেগেনে প্রথমবার পুজো দেখার সময় এক বিস্ময় মিশ্রিত আনন্দে মন ভরে উঠেছিল। সময়ের সীমাবদ্ধতায় মাত্র দু’দিনে কী অসাধারণ নিষ্ঠা আর দক্ষতায় পূর্ণাঙ্গ দুর্গোৎসব সম্পন্ন করা যায়, তা দেখে অবাক হয়েছি! শুনেছি, আমেরিকাতেও নাকি একইভাবে বিভিন্ন ক্লাব আলাদা আলাদা সপ্তাহান্তে দুর্গোৎসব পালন করে। আবার হামবুর্গে এসে দেখেছি একটু অন্য ছবি। পুজোর জন্য ঠিকঠাক জায়গা কিংবা হল ভাড়া পাওয়া গেলে নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট মেনেই সাত সমুদ্রের পারেও পুজো সম্পন্ন হয়।
এই বছর হামবুর্গে একদল বাঙালি মহিলার উদ্যোগে এক নতুন পুজোর আয়োজন করা হচ্ছে। উৎসবের আবহ জারি রাখতে মহিলা সদস্যদের সৃজনশীলতায় জন্ম নিয়েছে এক মৌলিক পুজোর গান, ‘দুর্গা এলেন হামবুর্গে’। বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যে তা সাড়া ফেলেছে।
প্রবাসে পুজোতে আমরা চেষ্টা করি পুজোর নিয়মগুলি যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে পালন করার। তবে স্থান, কাল, পরিস্থিতির কারণে কিছু নিয়ম-নীতি নিজের মতো করে মানিয়ে নিতে হয়। যেমন অবাঞ্ছিত ঝুঁকি এড়াতে হামবুর্গের এই নতুন সংগঠনে প্রতিমা আনা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ নেদারল্যান্ডসের একটি পুজো সংস্থা থেকে। আবার কোপেনহেগেনে দেখেছি, আগের বছরের মূর্তিকেই নতুন করে সাজিয়ে পুজোমণ্ডপে প্রতিষ্ঠা করা হয়। চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহনের পদ্ধতিগুলো আলাদা হলেও পুজোর অন্যান্য বিধি, নিয়মগুলি, যেমন পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধ্যারতি, সন্ধি পুজো, কুমারী পুজো থেকে শুরু করে দশমীর ধুনুচি নাচ ও সিঁদুর খেলা – সব কিছুই পালন হয় মহাসমারোহে।
দেবী পুজোর সঙ্গে সঙ্গে থাকে ‘পেট পুজো’র আয়োজনও! আমিষ-নিরামিষ মিলিয়ে প্রতিদিনই থাকে বিভিন্ন খাবারের সমাহার। বিদেশের মাটিতে এক টুকরো বাঙালিয়ানা তুলে আনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। নাচ-গান-নাটক-আবৃত্তি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জমে ওঠে সান্ধ্য-আসর।
ঢাকের বাদ্যি, পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র, ভোগের গন্ধ, আড্ডা, খুনসুটি, গল্প! সব মিলিয়ে প্রবাসী পুজো আমাদের নিয়ে যায় শৈশবের নস্টালজিয়ায়। বাঙালি-অবাঙালি, স্বদেশি-বিদেশি নির্বিশেষে পুজোর আনন্দে মেতে ওঠে আপামর উৎসবপ্রিয় মানুষ। দেশ–কাল–সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে ‘সর্বজনীন’ দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে ‘বিশ্বজনীন’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.