বিশ্বদীপ দে: শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পর নেপাল। বিপ্লব ও জনরোষের ছায়া ভারতের আরেক প্রতিবেশী দেশে। পথে মানুষের জটলা, প্রতিবাদ। এই মাসের শুরু থেকেই ‘রাজা আয়ু দেশ বাঁচাউ’ ও ‘হিন্দু রাষ্ট্র জিন্দাবাদ’ স্লোগানে ভরে উঠেছিল নেপালের আকাশ-বাতাস। এই স্লোগান ও মিছিল থেকে বোঝা গিয়েছিল নেপালের রাজনৈতিক পরিবেশ ও লাগাতার দুর্নীতির অভিযোগেই ক্ষুব্ধ সেদেশের তরুণ প্রজন্ম। ক্রমে বিদ্রোহের আগুনের আরও বিপজ্জনক ভাবে জ্বলে ওঠে। অন্ধ আবেগ আর ক্রোধে রাতারাতি কেপি শর্মা ওলি সরকারের পতন। অগ্নিগর্ভ নেপালের হাল ধরেছেন সেদেশের প্রাক্তন বিচারপতি সুশীলা কারকি। গত একসপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক চর্চায় উঠে এসেছে নেপাল। সেখানে যেমন নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তেমনই কথা হয়েছে নেপালের ইতিহাস নিয়েও। আর সেই ইতিহাসের এক আশ্চর্য অংশ হল- নেপালের কোনও স্বাধীনতা দিবস নেই!
নেপালের একটি জাতীয় দিবস আছে। সেটা সরকারি ছুটির দিন। ১৯২৩ সালের সেদিনই নেপাল-ব্রিটেন চুক্তি হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২৮ মে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তিতে ঘোষিত হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় গণপ্রজাতান্ত্রিক নেপাল। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস? নেই! কেন এমন ব্যাপার? আসলে প্রাচীনকাল থেকেই নেপাল স্বাধীন রাষ্ট্র। কখনওই কোনও বিদেশি শক্তি তাদের অধীনস্থ করতে পারেনি। পরাধীনতাই যেখানে নেই, সেখানে স্বাধীনতা আলাদা করে উদযাপন করার দিনও নেই।
অথচ সেই চতুর্দশ শতক থেকে আক্রমণের মুখে পড়েছে নেপাল। ১৩৪৯ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস কাঠমান্ডু আক্রমণ করেন। কিন্তু গোর্খা সেনা সেই হামলা রুখে দেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মীর কাশিম নেপালে আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও গোর্খাদের সঙ্গে লড়াইয়ে রণ ভঙ্গ দেন তাঁরা।
১৭৫৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়। বণিকের মাণদণ্ড রাজদণ্ড রূপে দেখা দেয়। ব্রিটিশদের ‘টার্গেট’ ছিল নেপালের দিকেও। ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ সাল পর্যন্ত দু’বছর ধরে চলে দুর্দান্ত লড়াই। কিন্তু গোর্খা যুদ্ধ নামে খ্যাত সেই যুদ্ধের সেই অর্থে কোনও নিষ্পত্তি হয়নি। তবে সুগৌলির চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের হাতে কুমায়ূন ও গাড়োয়াল অঞ্চল ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয় নেপাল। তার বিনিময়ে ব্রিটিশরা প্রতিশ্রুতি দেয় তারা আর আক্রমণ করবে না নেপালে। এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দিতে হলেও শেষপর্যন্ত এভাবেই বাকি অংশের স্বাধীনতা রক্ষা করেছিল তারা। অমর সিংহ থাপা, বলভদ্র কানওয়ার, ভক্তি থাপা- নামগুলি থেকে গিয়েছে নেপালের সেই সংগ্রামের তিন যোদ্ধা হিসেবে। কিন্তু সত্যিই কি কেবল নেপালিদের শৌর্যেই পিছু হটেছিল দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ সেনা। তা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে।
আসলে চিন ও ব্রিটিশদের অধীনস্থ ভারতের মাঝে নেপাল হয়ে উঠেছিল এক বাফার রাষ্ট্র। কাজেই আরেক সাম্রাজ্যবাদীর সংস্পর্শে না থেকে মাঝখানে নেপালকে রাখাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেছিল ব্রিটিশরা। তবে সেই সঙ্গেই তারা গোর্খা সৈন্যদের ব্রিটিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। পাশাপাশি নেপালের প্রাকৃতিক সম্পদও ব্যবহার করেছিল। কিন্তু নেপালের কোনও বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পদ ছিল না। ফলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সিংহ বুঝতে পেরেছিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যা, তাতে নেপাল দখল না করাই তাদের জন্য সুবিধাজনক হবে।
ইতিহাসে কিন্তু ওই একটিই ব্রিটিশ-গোর্খা যুদ্ধ নয়। বরং আরও আগে, ১৭৬৭ সালেও তাদের মধ্যে লড়াই হয়। কাঠমান্ডুর রাজা ও ব্রিটিশদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর যখন গোর্খালিরা রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন সাহেবরা রাজা হয়ে লড়তে সম্মত হয়। ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন কিনলক। যুদ্ধে গোর্খালিরা দারুণভাবে জয়লাভ করে। হাজারেরও বেশি ব্রিটিশ সৈন্যের মৃত্যু হয়। বাকিরা পালিয়ে বাঁচে।
মনে রাখতে হবে, উনবিংশ শতাব্দীর সেই সময়টায় ভারতীয় উপমহাদেশে দু’টিই প্রধান শক্তি ছিল। একদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অন্যদিকে নেপালের গোর্খালি সেনা। তবে দ্বিতীয়বারের যুদ্ধের ফলাফল যা হয়েছিল তাতে শেষপর্যন্ত ক্ষতি হয়েছিল গোর্খালিদেরই। স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারলেও তাদের খোয়াতে হয়েছিল এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডও।
আসলে নেপাল বরাবরই ব্রিটিশদের কাছে মশা-অধ্যুষিত, নির্জন, রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা এক প্রদেশ ছিল। সেখানে দাপট উপজাতিদের। তাই নিতান্তই সুকৌশলে নেপাল পুরোপুরি দখল না করে সেখানে আধিপত্য কী করে বজায় রাখা যায় সেটার নিখুঁত নীল নকশা তৈরি করেছিল। এবং সেই নকশা মেনেই কার্যসিদ্ধি করেছিল ধুরন্ধর ব্রিটিশরা। কাজেই স্বাধীনতা দিবস না থাকলেও ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদের ফাঁস থেকে নেপাল কিন্তু নিজেদের শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি পুরোপুরি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.