প্রতীকী ছবি
প্রসেনজিৎ দত্ত: ভারতীয় ফুটবল সেনসেক্সের গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী। নামতে নামতে ফিফার ক্রমতালিকায় ১৩৩-এ চলে গিয়েছে ভারত। অথচ তিন দশক আগেও ছবিটা এতটা করুণ ছিল না। যখন জাতীয় লিগ শুরু হল, ভারতীয় দলের র্যাঙ্কিং ছিল ৯৪। এরপর কেবলই ‘পতন’ দেখেছে ভারতের জাতীয় ফুটবল। এই গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হবে কীভাবে? এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। জাতীয় লিগ থেকে আই লিগ, আই লিগ থেকে আইএসএলের আগমন দেখেছি আমরা। তাতে আই লিগের মতো প্রতিযোগিতা রাতারাতি পেয়েছে ‘দু-নম্বরে’র মর্যাদা। সে জৌলুস হারিয়েছে। সেখানে ফুটবলাররা যতই ভালো খেলুন না কেন, কদর পান না সহজে। সকলেরই আশা করি মনে আছে, আইএসএলের প্রথম মরশুমে রবার্তো কার্লোস, গার্সিয়াদের মতো ফুটবলারদের এনে চমক দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল। তাও যে ধোপে টেকেনি, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এখন। বিচ্ছিন্নভাবে এর প্রতিবাদও হয়েছে। নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার কথা ভেবে প্রতিবাদে পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এসব ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’-এর মতো নির্মম পরিহাসে গৌণ। ভারতীয় ফুটবলের দৈন্যদশা আজ প্রকট। তাই জাতীয় দলের নতুন কোচ নিয়োগের প্রাক্কালে প্রশ্ন উঠছে, এভাবে কি আদৌ ভারতীয় ফুটবলে উন্নতি সম্ভব?
র্যাঙ্কিংয়ের দিক থেকে সেই তো কবে থেকেই পিছড়েবর্গদের দলে ভারতীয় ফুটবল। কিন্তু যেসব ফুটবল ক্লাব আজ বন্ধ, তাদের কি সুদিন ফিরবে? মহাধুমধাম করে চালু হয়েছিল জাতীয় লিগ। পরে তা নাম বদলে আই লিগ হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, জাপানের জে লিগের মতো করেই ন্যাশনাল লিগকেও এককালে সাজানো হয়েছিল যত্ন করে। তৃণমূল স্তর থেকে ফুটবলার তৈরির ভাবনা ছিল। সেভাবেই এগোচ্ছিল। রমরম করে চলছিল ভারতীয় জাতীয় লিগ। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বি ছাড়াও বঙ্গের বাইরের বিভিন্ন রাজ্যে মাঠভর্তি থাকত। এর ফলও পেয়েছিল ভারতীয় ফুটবল দল। ১৯৯৭-এ ভারত চ্যাম্পিয়ন হল সাফ গেমসে। ১৯৯৯-এ আবারও চ্যাম্পিয়ন হল এই প্রতিযোগিতায়। ২০০২-এ বিশ্বকাপ যোগ্যতা অর্জন পর্বে ভারতের শুরুটা ছিল ঈর্ষণীয়। যতদূর মনে পড়ে, আরব আমিরশাহিকে ১ গোলে হারিয়ে স্বপ্নের সিঁড়িতে উঠেছিল ভারত। পরের ম্যাচে ইয়েমেনের সঙ্গে ১-১ ড্র করে পরের রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে ভারত। কিন্তু শেষ ম্যাচে ব্রুনাইয়ের কাছে ০-৫ গোলে হেরে ভারতের বিশ্বকাপে যাওয়ার স্বপ্নের ব্যাঘাত ঘটেছিল। মনে পড়ছে, ২০০২ সালে এলজি কাপ জেতে ভারত। কোচ ছিলেন স্টিফেন কনস্ট্যানটাইন। ২০০৭-এ সালে কোচ বব হাউটনের হাত ধরে নেহরু কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত।
এই জাতীয় লিগ বা আই লিগের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলত ভারতের তথা এশিয়ার প্রাচীনতম কলকাতা ফুটবল লিগ। সেই লিগ তার আভিজাত্য হারিয়েছে। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ফেডারেশন কাপ, রোভার্স কাপের মতো টুর্নামেন্টও। কোনও আশ্চর্য ‘ক্ষমতা’র চপেটাঘাতে বহু ক্লাবই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। অর্থ? নেই। লগ্নিকারী সংস্থা? কেউ এগিয়ে আসেনি এক সময়। ক্লাব অর্থনীতি? কোষাগার প্রায় খালি… এসব শুনে শুনে এমন দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি করা হল যে, সমর্থকদের মনেও গ্রাস করে বসল নেতিবাচকতা। যে সমর্থকরা মাঠ ভরাতেন, খেলা হলে রূপকথার বিনুনি বুনতেন, তাঁরাই বিশ্বাস করে নিলেন সত্যিই হয়তো কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে হাত না মেলালে আর কিছুই হওয়ার নয়। শেষমেশ এল আইএসএল। একদল এতে ‘আহা ভারতীয় ফুটবলে বিপ্লব হল’ বলে আহ্লাদিতও হলেন। আইএসএল নামক প্রতিযোগিতা শুরুর সময় ঢালাও করে যে গ্রাস রুট পরিকল্পনার কথা বলা হল, সেসব বিশ বাঁও জলে। লিগে এখনও চালু করা গেল না রেলিগেশন।
এই পরিস্থিতিতে ডামাডোল অব্যাহত ভারতীয় ফুটবলে। সম্প্রতি ফেডারেশনের তরফে যে বার্ষিক ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে ছিল না আইএসএলের দিনক্ষণ। জানা গিয়েছিল, ফেডারেশনের কাছে কয়েক প্রস্থ প্রস্তাব জানিয়েছে ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড বা এফএসডিএল। সেখানে আরও ১০ বছর প্রস্তাবিত লিগে অবনমন চালু না হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, এফএসডিএলের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কোনও মউ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। আর এই আবহে এমন প্রস্তাবে কার্যত বেকায়দায় পড়েছে ফেডারেশন। এমনিতেই যথেষ্ট চাপে রয়েছে তারা। আইএসএল থেকে এখনও মোটা অঙ্কের টাকা বকেয়া রয়েছে ক্লাব ও ফ্র্যাঞ্চাইজির। আর এই অবস্থায় নতুন পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যেই পেশ করেছে এফএসডিএল। সেখানে খরচ কমানোর দিকেই মূল নজর রেখেছে তারা। এভাবে চলতে থাকলে উন্নতি নয়, বরং পিছিয়ে যেতে যেতে ক্রমশ পিছলে পড়বে ভারতীয় ফুটবল। এই দেশই তো এককালে শৈলেন মান্না, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী থেকে বাইচুং ভুটিয়া, আইএম বিজয়ন, সুনীল ছেত্রীদের মতো দিকপাল ফুটবলারদের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এখন তো তাঁদের কাছাকাছি মানের ফুটবলার তৈরিই হয় না। তাই অবসর ভেঙে ফিরে আসতে হয় সুনীল ছেত্রীকে। এই পিছিয়ে যাওয়ার দায় কার? দৈন্যদশা মিটবেই বা কীভাবে?
ভারতীয় ফুটবলের মানোন্নয়নের জন্য দ্রুত বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সঠিক পদ্ধতিতে মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা তৈরি করতে হবে। তৈরি করতে হবে যথাযথ ব্র্যান্ডিং। আঞ্চলিক ক্লাবগুলিকে নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। কিংবদন্তি ব্রাজিল ফুটবলার জিকো যখন জাপানের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তিনি জাতীয় দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি ফেডারেশনকে বছরে দু’বার জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত নয় অথচ সম্ভাবনাময় ফুটবলারদের তালিকা পেশ করতেন। এর ফলে জাপানের জাতীয় দলের রিজার্ভ বেঞ্চের পুল আরও বড় হয়ে গিয়েছিল। এই মডেল অনুসরণ করে চিফ কোচের মাধ্যমে এমন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের চিহ্নিতকরণ প্রয়োজন। যাতে প্লেয়িং ইলেভেনে একজন খেলোয়াড় হঠাৎ চোট পেলে একাধিক বিকল্প হাতে থাকে। ডেভেলপমেন্ট টিমকে যেভাবে ইন্ডিয়ান অ্যারোজ নাম নিয়ে আই লিগে খেলানো হত, সেরকমই আবারও ডেভেলপমেন্ট টিম খেলাতে হবে। কারণ অতীতে ইন্ডিয়ান অ্যারোজ থেকে অনেক খেলোয়াড়ই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে। তাছাড়াও যুব ও স্কুল স্তরে নিয়মিতভাবে ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজন করাও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সুব্রত কাপের মতো আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট মডেল হতে পারে। ১৯৬০ সাল থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টের নামকরণ করা হয়েছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নামে। এটি ভারতের প্রাচীনতম জাতীয় স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ফুটবলের প্রসারের উদ্দেশ্যেই প্রতিযোগিতাটি শুরু হয়েছিল। ‘মিশন ট্রিনিটি’ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০২ সাল থেকে জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তৃণমূল পর্যায় থেকে ফুটবলার তৈরি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলও পেয়েছে তারা। কাতার বিশ্বকাপে জার্মানি ও স্পেনের মতো দলকে পরাজিত করেছে তারা। প্রয়োজনে এই দেশেও এমন প্রকল্প চালু করতে হবে।
বাড়াতে হবে টুর্নামেন্টের সংখ্যাও। ক্রিকেটের মতো ফুটবলেও জাতীয় স্তরের নির্বাচকদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা দেখতে যেতে হবে। নতুন ফুটবলার তুলে আনার ক্ষেত্রে এভাবেই ভূমিকা নিতে হবে তাঁদের। আস্থা রাখতে হবে ভারতীয় কোচের উপরেও। একই সঙ্গে রেফারির মানোন্নয়নেরও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সঠিক ট্রেনিং স্কুল, স্পোর্টস সায়েন্স এবং ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন। ভার প্রযুক্তি চালু করতে হবে ভারতীয় ফুটবলে। ব্যয়বহুল এই পদ্ধতি নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। এক্ষেত্রে দেশের স্বনামধন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গবেষক, অধ্যাপকদের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখতে পারে ফেডারেশন। সম্প্রতি VAR-এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো একটি প্রযুক্তি রূপায়ণ করে এআইএফএফের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। যে প্রযুক্তির পোশাকি নাম ‘অ্যাডভান্সড রিভিউ টেকনোলজি’ বা ART। এর প্রথম ধাপে কেবল গোললাইন প্রযুক্তি নিয়েই কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক প্রণিবেশ মণ্ডল এবং আশিস পাল। ভার প্রয়োগে অক্ষমতার মঝে যা ভারতীয় ফুটবলে টাটকা বাতাস আনতে প্রস্তুত। একবছর ধরে গবেষণার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীদের গবেষণালব্ধ এই নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে বল গোললাইন অতিক্রম করেছে কি না, তার অনেকাংশে নির্ভুল নির্ণয় সম্ভব। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরও ফুটবল সংক্রান্ত এটাই প্রথম কাজ। দূরত্ব কমাতে হবে ক্লাব ও জাতীয় স্তরের মধ্যে। মাঠের মানের উন্নতির প্রয়োজন। তাই কেবল কোচ বদল করলেই হবে না, বেশ কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে। তাহলেই বিশ্ব ফুটবলের ‘ঘুমন্ত দৈত্য’ ভারত জেগে উঠবেই উঠবে। জাগো দুস্তর পথের নব যাত্রী… সময় তো এটাই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.