সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সীমান্তবর্তী ফাজিলকা জেলার ছোট্ট এক গ্রাম চক খেরেওয়ালা। প্রকৃতির কৃপাদৃষ্টিতে সেখানে এ বছর সুফলং মরশুম। সেই গ্রামেরই মূল মোড়ে দেখা গেল গভীর আলোচনায় মগ্ন সরপঞ্চ রাঙ্গা রাম। গম চাষের হার নিয়ে চলছে বাক্যালাপ। হঠাৎই বছর এগারোর একটি ছেলে ছুটে এসে বড়দের কথায় বাধা দিয়ে গড়গড়িয়ে বলে উঠল, “শুবু পাজি ইন্ডিয়া টেস্ট টিম দে ক্যাপ্টেন বান গে (শুবু পাজিকে ভারতীয় টেস্ট টিমের অধিনায়ক করা হয়েছে)।” ছেলেটির নাম লাভদীপ সিং। সে গ্রামের সবচেয়ে ‘বিখ্যাত বাড়ি’র কাছেরই এক সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করে। আর হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত বাড়িটিতে থাকে শুভমান গিলের পরিবার।
শনিবার, ইংল্যান্ড সফরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ভারতীয় টেস্ট দল। জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হবে শুভমান গিলের। ক্রিকেট খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী গ্রামে বেড়ে ওঠা ‘শুবু পাজি’কে। অপলকা গিলি-ডান্ডা, পালিশহীন ব্যাটের শরীরে এখন বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞাপন। গ্রামের গণ্ডি ছেড়ে এখন দুনিয়া ভ্রমণ করছেন ‘গ্রামের ছেলে’ শুভমান। তাই ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে এখন উৎসবের মেজাজ। সেখানকার আনাচ-কানাচে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ‘শুবু পাজি’র গল্প… গ্রামের প্রতিটি কোনায়, চায়ের দোকানে, খেতের আলপথ থেকে ভেসে আসছে তাদের আদরের শুভমানকে নিয়ে গর্বের অনুভূতি।
গ্রামে গিল পরিবারের নামে এখন ৬০ একরেরও বেশি জমি। এসবই তাঁদের পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ। কিন্তু ১৮ বছর আগে তাদের বেছে নিতে হয় গ্রাম ও শহরের মধ্যে যেকোনও একটি। আসলে পরিস্থিতিই অনেকটা এমন ছিল। শুভমানের বয়স তখন ৭। তার বাবা চেয়েছিল মোহালিতে চলে যেতে। সেখানে তাঁর আদরের শুবু অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবে। ক্রিকেটেও মন দিতে পারবে। দাদু-দিদারাও ওই সময় মোহালি চলে যেতে পারতেন। কিন্তু শহুরে সুখ-বিলাসকে নয়, তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন দেহাতি জীবনকে। এবার একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে জানা যাবে, তিনটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় শুভমানের দাদু দিদার সিং বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে সপরিবারে চলে গিয়েছিলেন মুক্তসার। যদিও যুদ্ধের আঁচ কমলে তাঁরা ফিরে আসেন পূর্বপুরুষের ভিটেতে। কিন্তু ১৮ বছর আগে যখন ফের সুযোগ আসে শহর যাওয়ার। তখন যাননি কেন তাঁরা? আসলে দিদার সিংয়ের মতো মানুষের মনের স্বরলিপিতে লেখা মেঠো সুর। তা থেকে সহজে বেরোনো যায় নাকি? তাই চক খেরেওয়ালাই তাঁদের বেঁচে থাকার ঠিকানা। তাঁরাই এখন বিশাল ওই কৃষিজমি দেখাশোনা করেন।
শুভমানের পিসি গুরপ্রীত সান্ধু বলেন, “সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়ায় এখানকার মানুষ কৃষিজীবী। আমার বাবা সব সময় কৃষক হিসেবে গর্ব করতেন। কিন্তু আমার ভাই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে ভাবুন। ভাইয়ের সঙ্গে আমার বাবার নাতি-নাতনিরাও কিন্তু গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ ছেলেকে ছাড়া, নাতি-নাতনিদের ছাড়া জীবন কাটানোর অভ্যাস করতে হবে বাবাকে। আবার ভাইও ওর বাবাকে ছেড়ে, নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে বহুদূর চলে যাচ্ছে। বিষয়টা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। লোকজন ঠাট্টা করত। বলত, ক্রিকেট শিখতে কে এতদূর যায়! কিন্তু কাউকে না কাউকে তো ত্যাগ স্বীকার করতেই হত। আমার বাবা আর ভাই, দু’জনেই শুভমানকে ক্রিকেটার বানাতে সেই ত্যাগ স্বীকার করেছে। আজ সেই শুভমান ভারতকে নেতৃত্ব দেবে। এর চেয়ে গর্বের মুহূর্ত আর হতে পারে না।”
আর গর্বের সঙ্গে রাঙ্গা রাম বলেন, “জায়গাটি এখন ভারত অধিনায়কের গ্রাম হিসেবে পরিচিত হবে।” চক খেরেওয়ালার পাশের গ্রাম বাহমানিওয়ালা। সেখানে এখন শুভমানের সম্মানে গড়ে উঠবে নতুন একটি স্টেডিয়াম। ফাজিলকা জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন এই উদ্যোগ নিয়েছে। এভাবেই শুভমান গোটা গ্রামে প্রভাব ফেলেছেন। ফাজিলকা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সচিব সুরিন্দর ছিন্দি বলেন, “এখানকার মানুষের ক্রিকেটের ব্যাপারে আগে আবেগ প্রায় ছিলই না। তাঁরা সন্তানদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করত না। কিন্তু খবরের শিরোনামে শুভমান উঠে আসার পর থেকে এখানকার ছবিটা বদলে যেতে শুরু করে। যদিও এখানে অ্যাকাডেমি বেশ কম। কিন্তু আশা করি শুভমানের গ্রামের পাশে স্টেডিয়াম তৈরি হয়ে গেলে দ্রুত পরিস্থিতির বদল হবে।” জানা গিয়েছে, স্টেডিয়ামের তৈরির জমি দেওয়া হয়েছে পঞ্চায়েত থেকে। সব মিলিয়ে একটা খুশি খুশি রব গিলের গ্রামের পরিবারে। এমন মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে শুভমানের ৮৮ বছরের দাদু গোটা গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করছেন। তাঁর চোখে নতুন স্বপ্ন। লাল বলের ক্রিকেটে ভারতকে শীর্ষে পৌঁছে দেবেন তাঁর নাতি, ‘ক্যাপ্টেন শুভমান’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.