সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: প্রায় দেড় দশক আগে ঘটে যাওয়া মালেগাঁও বিস্ফোরণের ঘটনা বৃহস্পতিবার ফের সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে। ঘটনায় সাত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করেছে এনআইএ বিশেষ আদালত। তাঁরা হলেন বিজেপি নেত্রী প্রজ্ঞা ঠাকুর, কর্নেল প্রসাদ, প্রাক্তন মেজর রমেশ উপধ্যায়, সুধাকর চতুর্বেদী, অজয় রাহিরকর, সুধাকর ধার দ্বিবেদী ওরফে আলিয়াস শংকরাচার্য এবং সমীর কুলকার্নি। তবে এই ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল বাংলার স্বামী অসীমানন্দেরও। যদিও পরে চার্জশিট থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু কে এই স্বামী অসীমানন্দ?
কখনও তিনি নবকুমার, কখনওবা যতীন চট্টোপাধ্যায়, আবার কখনও ওঙ্কারনাথ। নামের সমাহারে সজ্জিত গেরুয়া বসনধারী স্বামী অসীমানন্দ প্রথমদিকে পরিচিত ছিলেন হিন্দু কট্টরপন্থী নেতা হিসাবে। কিন্তু ক্রমেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা থেকে তাঁর কপালে জোটে ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদী’র তকমা। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনায় নাম জড়ায় বাংলার স্বামী অসীমানন্দের। কিন্তু একদা পরিচিত এই হিন্দু কট্টরপন্থী নেতা কীভাবে ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদের’ মুখ হয়ে উঠলেন?
অসীমানন্দের পারিবারিক ইতিহাস যথেষ্ট গৌরবময়। তাঁর বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভূতিভূষণ সরকার। বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় পুত্রই হলেন অসীমানন্দ। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি করার সময়েই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে (আরএসএস) যোগ দেন তিনি। এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে সক্রিয় ভাবে বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুসিত এলাকাগুলিতে সঙ্ঘের হয়ে প্রচারের কাজ শুরু করেন। কিন্তু পরে আরএসএসের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। বিরোধ চরমে পৌঁছলে অসীমানন্দ আরএসএস ত্যাগ করে ‘অভিনব ভারত’ নামে অন্য একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথম থেকেই অসীমানন্দ সুবক্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বক্তৃতার মূল উপাদানই ছিল সংখ্যালঘু এবং খ্রিস্টান মিশনারি বিরোধী প্রচার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বক্তৃতা করার জন্য একসময়ে তাঁর ডাক আসতো। ১৯৯০ সালের শেষের দিক থেকে তিনি পাকাপাকিভাবে গুজরাটের ডাং জেলায় বসবাস শুরু করেন। যেখানে তিনি ‘শবরী ধাম’ নামে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন স্থাপন করেন।
সালটা ২০০২, একটি ঘটনা, অসীমানন্দের সংখ্যালঘু বিদ্বেষ আরও লক্ষ্য-কোটি গুণে বাড়িয়ে দেয়। গুজরাটের গান্ধীনগরের অক্ষরধাম মন্দির হামলা চালায় একদল জঙ্গি। পবিত্র ভূমিতে বয়ে য়ায় রক্তস্রোত। মৃত্যু হয় ৩০ জন পুণ্যার্থীর। এরপরই নিরীহ দেশবাসীর রক্তের বদলা নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন অসীমানন্দ। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এখান থেকেই এই হিন্দু কট্টরপন্থী নেতার জীবন এবং চিন্তাধারা এক নতুন মোড় নেয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই ঘটনার সাত বছর পর থেকে অর্থাৎ ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দেশের মাটিতে অন্তত চারটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা। এগুলি হল- সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ (২০০৭), আজমের বিস্ফোরণ (২০০৭), মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ (২০০৭) এবং মালেগাঁও বিস্ফোরণ (২০০৮)। প্রত্যেকটিতেই নাম জড়ায় অসীমানন্দ ওরফে নবকুমার, ওরফে যতীন চট্টোপাধ্যায় ওরফে ওমকারনাথের। যদিও পরে প্রতিটি মামলাতেই বেকসুর খালাস পেয়ে যান অসীমানন্দ। এরপরই ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদ’ তত্ত্ব তুলে ধরেন ইউপিএ সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্ডে। বিস্ফোরণের নেপথ্যে আরএসএস ও বিজেপির একাংশ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছিলেন তিনি। যদিও গেরুয়া শিবির সেই অভিযোগ নস্যাৎ করেছিল। তারা পালটা দিয়ে জানায়, কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে।
সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ (২০০৭)
২০০৭ সালে ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলা সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি। প্রাণ হারান প্রায় ৬৪ জন নিরীহ যাত্রী। এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই পাকিস্তানি নাগরিক।
আজমের শরিফ বিস্ফোরণ (২০০৭)
২০০৭ সালে আজমেরের বিখ্যাত মইনুদ্দিন চিস্তির দরগায় ঘটা এক বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল তিনজন নিরীহ লোকের। আহত হয়েছিলেন প্রায় ১৫ জন। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় অসীমানন্দ-সহ বেশ কয়েকজনকে। জেরায় জঙ্গিযোগের কথা স্বীকার করেছিলেন অসীমানন্দ বলে নিজেদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল রাজস্থান পুলিশের জঙ্গিদমন শাখা। তবে তা ধোপে টেকেনি।
মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ (২০০৭)
২০০৭ সালে হায়দরাবাদের চার্মিনার সংলগ্ন মক্কা মসজিদে নমাজের সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে হয়। মৃত্যু হয় ৯ জনের। এই ঘটনার পর মসজিদের বাইরে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। সেখানে আরও ৫ জন মারা যান।
মালেগাঁও বিস্ফোরণ (২০০৮)
২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার মালেগাঁও শহরে ভয়ংকর বিস্ফোরণে হয়। ৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছিলেন একশোর বেশি। তদন্তে উঠে আসে, মালেগাঁও শহরে মসজিদ লাগোয়া কবরস্থানে একটি মোটরবাইক দু’টি বোমা রাখা ছিল। তাতেই বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনাতেও নাম জড়ায় অসীমানন্দের। যদিও পরে চার্জশিটে নাম ছিল না তাঁর।
অসীমানন্দ ছাড়াও মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডে অন্যান্য অভিযুক্ত হলেন প্রজ্ঞা ঠাকুর, কর্নেল প্রসাদ, প্রাক্তন মেজর রমেশ উপধ্যায়, সুধাকর চতুর্বেদী, অজয় রাহিরকর, সুধাকর ধার দ্বিবেদী ওরফে আলিয়াস শংকরাচার্য এবং সমীর কুলকার্নি। তবে বৃহস্পতিবার তাঁদের বেকসুর খালাস ঘোষণা করে এনআইএ বিশেষ আদালত। বিচারক একে লাহোটির পর্যবেক্ষণ, কেবল সন্দেহের বশে মামলা এগোনো যায় না। আরও বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার পক্ষ। মালেগাঁওয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় এই ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে কথা ওঠে। যদিও এদিন বিচারক বলেন, “সন্ত্রাসবাদের কোনও ধর্ম হয় না।” আদালতের এই নির্দেশের পরই কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে তরজা শুরু হয়েছে। এক বিজেপি নেতার কথায়, “আদালত প্রমাণ করে দিয়েছে হিন্দু সন্ত্রাসবাদ বলে কিছু হয় না।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.