Advertisement
Advertisement
Ghost

তেনারা অনেকেই আজ নিরুদ্দেশে, বাঙালি ভূত কি এক বিপন্ন প্রজাতি?

ভূতগুলো সব গেল কোথায়?

The lost ghosts of Bengal, exploring the unexplored। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:October 29, 2021 8:35 pm
  • Updated:October 30, 2021 4:18 pm  

বিশ্বদীপ দে: পুরনো সময়, হারানো দিনের জন্য হাপিত্যেশ বাঙালির মজ্জাগত। স্বর্ণযুগের গানের প্রসঙ্গ উঠলেই শোনা যায়, এমন গান আর হবে না। সাহিত্যেও বঙ্কিম-রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের সময় আর ফিরবে না বলেও আপশোসের শেষ নেই। একই ব্যাপার ভূতের ক্ষেত্রেও। যাঁরা পুরনো সময়ের ভূতপ্রেতের (Ghost) খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা মনে করিয়ে দেন আগে বাঙালির (Bengali) ভূতের ভাঁড়ার ছিল পেল্লাই বড়। কিন্তু কালক্রমে ভূতের সেই ‘দিন গিয়াছে’। এখানেও চিরকালীন আক্ষেপের চেনা গন্ধ। বহুদিন আগেই রমাপদ চৌধুরী প্রশ্নটা তুলে দিয়েছিলেন, ‘ভূতগুলো সব গেল কোথায়?’

Advertisement

আর এখানেই মনে পড়ে যায় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়কে। ব্যঙ্গকৌতুক রসের অমোঘ স্রষ্টার রসস্নিগ্ধ পঙক্তি, ”যেমন জল জমাইয়া বরফ হয়। অন্ধকার জমিয়া তেমনি ভূত হয়।” কী সহজ অথচ কী অব্যর্থ বিশ্লেষণ। একথা ঠিকই, ত্রৈলোক্যনাথ এখানে ‘অন্ধকার’ শব্দটিকে আরও বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন। ‘মানুষের মনের ভিতর যে কত অন্ধকার’ আছে সেই হিসেবও দিয়েছিলেন তিনি। সেই মনের অন্ধকারকে সরিয়ে রাখলেও অষ্টাদশ শতাব্দী কিংবা আরও আগের সময়ে যখন ইলেকট্রিসিটির বালাই ছিল না, তখন সন্ধে নামলেই যে অন্ধকার ফুটে উঠত তাকেও অস্বীকারের উপায় নেই। সেই সব অন্ধকারের ইতিহাসেই রয়ে গিয়েছে এমন সব ভূত, যারা মিশে থাকত এই বাংলার জল-মাটি-হাওয়ার অন্দরেই। ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসের শুরুর দিকে ত্রৈলোক্যনাথের বর্ণনায় পাই, ”সন্ধ্যা হইলে, ঘরে বসিয়া, লোকে নানারূপ ভূতের গল্প করে, সেই গল্প শুনিয়ে বালক-বালিকার শরীর শিহরিয়া ওঠে।” খোদ বঙ্কিমচন্দ্রও নাকি মেদিনীপুরের কাঁথিতে দেখা পেয়েছিলেন এক প্রেতিনীর। যাকে নিয়েও লিখতে শুরু করেছিলেন ‘নিশীথ রাক্ষসীর কাহিনী’। সুতরাং আমজনতা থেকে খ্যাতিমান, বাঙালি জীবনে ভূতের আনাগোনা সেই সময় এক অন্য মাত্রা পেয়েছিল।

Ghost
পরশুরামের ‘ভূষণ্ডীর মাঠে’ গল্পে দেখা মিলেছিল হরেক ভূতের

[আরও পড়ুন: শারজার শাপমুক্তি সিডনিতে, ‘৯২ বিশ্বকাপে শচীনদের জয়েই তৈরি হয়েছিল পাক-বধের নীল নকশা]

চারপাশের আলোয় আজও টিকে রয়েছে তথাকথিত ‘মেনস্ট্রিম’ বাঙালি ভূতেরা। ব্রহ্মদৈত্য, মামদো, শাঁকচুন্নি, পেত্নি, যখের মতো চেনা ভূতেরা আজও ভেসে বেড়ায় গল্পকথায়। কিন্তু সেই অর্থে লিখিত নয়, মূলত লৌকিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা যে ‘লোকাল’ ভূতেরা, তারা কোথায় যে গেল! তারা কারা? কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।

একটামাত্র পা নিয়েই ঘুরে বেড়াত একানড়ে। ‘একটি নড়ি’ অর্থাৎ কিনা একখানা লাঠি হাতে ঘুরে বেড়ানো ভূত একানড়ের একটা মাত্র পা। আর সেটাকে সম্বল করে নড়বড় করে ঘুরে বেড়াত সে। স্বাভাবিক ভাবেই কল্পনা করতে গেলে গা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। এই ভূতকে অবশ্য বাংলা গানে ফিরিয়ে এনেছিল চন্দ্রবিন্দু। ‘আমার ঘাড়ে একানড়ে ঠ্যাং ঝুলিয়ে নাচে’…এই লাইনটির কথা মনে পড়ছে?

Ghost king
ভূতের রাজার বর পেতে কোন বাঙালি না চায়?

[আরও পড়ুন: অভিশপ্ত ছবি ‘দ্য ওমেন’! একের পর এক দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়েছিল কলাকুশলীদের]

আরেক সাংঘাতিক ভূত গলাসি। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে গলাসি হয়। মানুষকে সারাক্ষণ গলায় দড়ি দিতে উস্কানি দেওয়ার বদনাম তার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, তার সঙ্গে মোলাকাতও মোটেই সুখকর হত না।
কানাওয়ালা ভূত বা ভুলো আবার মানুষের দিক ভুলিয়ে দেয়। অর্থাৎ, রীতিমতো চেনা এলাকা দিয়েই আপনি যাচ্ছেন। আচমকা দেখলেন কিছুতেই আর গন্তব্যে পৌঁছতে পারছেন না। ঘুরপাক খেয়ে চলেছেন একই জায়গার ভিতরে। সুতরাং এও কিছু কম বিপজ্জনক নয়।

জটাধারীর বাস জলের তলায়। সাঁতার কাটতে কাটতে এর গায়ে পা দিয়ে ফেললেই গোলমাল! নিজের জটায় পা জড়িয়ে ধরে জলে ডুবিয়ে মারে জটাধারী। ত্রৈলোক্যনাথের লেখাতে একে আবার ‘জটে বুড়ি’ও বলা হয়েছে, যে শিকল হাতে জলের তলায় বসে থাকত। তবে এঁর দয়ায় অবশ্য হারানোর বাসন কোসন ভেসেও উঠত।

এবার যার কথা বলব, তিনি পাঁচু ঠাকুর। ইনি আসলে লৌকিক দেবতা। যদিও তাঁর দেহাকৃতি ও বেশভুষার সঙ্গে মিল রয়েছে শিবের। কেউ কেউ বলে থাকেন তিনি শিবেরই পুত্র। যাই হোক, এই পাঁচুরই দুই সঙ্গী জরাসুর ও ধনুষ্টংকার। এই সব অপদেবতারা ওই স্থানীয় ভূতেদের মতোই ‘লোকাল’ হয়ে উঠেছিলেন। আবার খোদ পাঁচু ঠাকুরও কোথাও কোথাও ‘চোয়ালে পেঁচো’ হয়ে শিশুদের ক্ষতিকারী প্রেতবিশেষ হয়ে উঠেছে স্থানীয় বিশ্বাসে।

এমনই ছিল সেই সব দিনকাল। ভূত-পেত্নিরা রীতিমতো পাড়া-প্রতিবেশীর মতোই মিলেমিশে থাকত। যেমন কুনি-বুনি। দু’জনেই জাতে পেত্নি। বাঁশবনে থাকে বুনি। ঘরের কোণের নোংরার স্তূপে বাসা কুনির। প্রচলিত ছড়াতে তাদের দেখা মেলে- ‘কুনিকে বলো, বুনির ছেলে হয়েছে/ দু-খান ন্যাকড়া চেয়েছে’। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসেও রয়েছে সোনাগাজির দরগায় কুনি-বুনির বাসা বাঁধার প্রসঙ্গ। পোঁটাচুন্নি নামের পেত্নিদের নাক দিয়ে সারাক্ষণই ঝরে পড়ত সর্দি। মাছের নাড়িভুঁড়ি এদের ফেভারিট ডিশ।

এমনই আরও আছে। উল্কাপেত্নি, নাড়াবুনে, গো-বাঘা আরও কত (এছাড়াও লাকিনী, শাকিনী, হাঁকিনীদের মতো উপদেবতারাও রয়েছে, তবে তারা ঠিক ভূত পদবাচ্য নয়)! এরা সকলেই আজ নিরুদ্দেশের দেশে। একটু খেয়াল করলে অনেকের মনে পড়বেই, আটের দশকের শেষভাগে ব্যান্ডেজ ভূত, শাহেনশাহ ভূতের কথা। আত্মীয়তায় এরা এই সব লৌকিক ভূতপ্রেতেরই উত্তরপুরুষ।

Ghost
গ্লোবালাইজেশনের ধাক্কায় নিখোঁজ বাঙালি ভূতের একাংশ

এরপরই হুড়মুড় করে এসে পড়েছিল গ্লোবালাইজেশনের আলো। আর সেই আলোর ঝলমলানিতে মিলিয়ে গিয়েছে বাংলার মাটির কাছাকাছি থাকা একানড়ে, পোঁটাচুন্নিরা। বাঙালি এখন ওয়েব সিরিজে বিলিতি ভূতের রোমাঞ্চের ওম পোহায়। ঘরে বসেই দেশ-বিদেশের হরেক কিসিমের ভৌতিক গল্প-উপন্যাস তার হাতের মুঠোয়। লোকাল ট্রেন নিয়ে তার মাথাব্যথা থাকলেও লোকাল ভূতে তার বোধহয় আর আগ্রহ-টাগ্রহ নেই। বড়জোর ব্রহ্মদৈত্য, মামদো, শাঁকচুন্নিদের এলিট উপস্থিতি খানিক ছুঁয়ে যায় তাকে। বাকিরা গায়েব।

তাহলে কি ভূত এক বিপন্ন প্রজাতি? না বোধহয়। বাঙালির ভূত-প্রীতি এত সহজে যাবে না। বাংলা সাহিত্য ঘাঁটতে বসলে ‘চৈতন্য চরিতামৃত’তে ভূতের উল্লেখ মেলে। হরিদাস নামের এক চৈতন্য ভক্তকে মৃত্যুর পরেও গান গেয়ে শোনাতে দেখা যেত। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে অন্নপূর্ণামঙ্গল- ভূত কোথায় নেই? সুতরাং বলাই যায়, সাহিত্য থেকে লোকায়ত জীবন- ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ’ কেবল সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিমই নয়, ভূতও। কাজেই গ্লোবাল ভিলেজে স্থানীয়ত্ব যতই হারাক ভূতের দল, তারা অবলুপ্ত হয়ে যাবে, এমন কোনও সম্ভাবনা নেই।

Ghost Image
‘ভূত থাকবে মানুষ থাকবে যতদিন’

এপ্রসঙ্গে শেষ কথা সম্ভবত লিখে গিয়েছেন বুদ্ধদেব বসুই। তাঁর ‘ভূতের ভয়’ প্রবন্ধে রয়েছে, ‘আজকের দিনের সব সত্য আর অঙ্ক- যা হচ্ছে গিয়ে ফ্যাক্টস, খবরের কাগজের সত্য… ওসব যখন ধুলো হয়ে হারিয়ে যাবে হাওয়ায়, তখনও ভূত থাকবে… ভূত থাকবে মানুষ থাকবে যতদিন। কে বলে ভূত নেই? ভূত যে আছে আমাদের মনের মধ্যে, আমাদের রক্তে… বাইরের কোনও জিনিস নয়, আমরাই তাকে সৃষ্টি করেছি মনের ইচ্ছা থেকে। ভূত আমরা চাই।’

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement