কত প্রিয় যে প্রয়াত হয়েছে দশকে দশকে! যা একদিন নৈমিত্তিক জীবনের সঙ্গে ফেবিকুইকের মতো চুপকেছিল, সেই জিনিস বেমালুম দেহ রেখেছে। এসির যুগে টানাপাখা তো ভূত, বুলেট ট্রেনের যুগে গরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ফিটন কিংবা পালকি। লিখছেন কিশোর ঘোষ।
‘এনা’দের জন্য মোটে কদর নাই ‘তেনা’দের! ‘এনা’রা বলতে সোজা-বাঁকা, মোটা-রোগা, লম্বা-বেঁটে… মসূয়ার রায় পরিবার কথিত ভূত। শাকচুন্নি থেকে স্কন্ধকাঁটা, মামদো থেকে ব্রহ্মদত্যি… যাকে বলে বাঙালির ভূতবিলাস। যার প্রমাণ দেন রবীন্দ্রনাথ থেকে রাজশেখর বসু, শরদিন্দু থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো বঙ্গীয় গপ্পকাররা। কিন্তু ‘তেনা’রা কারা? মশাই অতীতের কথা হচ্ছে। ভূত নেই বলে কী বাঙালির অতীতও নেই? কত প্রিয় যে প্রয়াত হয়েছে দশকে দশকে! যা একদিন নৈমিত্তিক জীবনের সঙ্গে ফেবিকুইকের মতো চুপকেছিল, সেই জিনিস বেমালুম দেহ রেখেছে। এসির যুগে টানাপাখা তো ভূত, বুলেট ট্রেনের যুগে গরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ফিটন কিংবা পালকি। এলইডি আলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যদি মনে পড়ে রেড়ির তেলের পিদিমের কথা…। এভাবে বলতে থাকলে তালিকা ফুরবে না। অতএব, গত তিন দশকের প্রিয় ‘ভূত’, (মতান্তরে অতীত) নিয়ে কথা বলব আমরা। যারা এককালে ছিল বঙ্গ জীবনের অঙ্গ, কালের নিয়মে যাদের ছেড়েছি সঙ্গ!
প্রয়াত চিঠি: চিঠি নিয়ে দু’কথা বলতে গেলে ভূত হয়ে যাওয়া এক কবি এবং এক সঙ্গীত পরিচালকের কথা মনে পড়বেই। তাঁরা সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং সলীল চৌধুরী। রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম…। ভারতে চিঠিচাপাটির গোড়াপত্তন তো এই বাংলায়। একটি মতে ১৮০০ সালে (মতান্তরে ১৭৭২ সালে) দেশের প্রথম ডাকঘর তৈরি হয়েছিল অখণ্ড বাংলার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরিতে। সে সময় এলাকাটি পরিচিত ছিল কেডগিরি নামে। অর্থাৎ কিনা দুশো বছরে দেহ রেখেছে ভারতের আধুনিক ডাকব্যবস্থা! তার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ-সহ অসংখ্য বিশিষ্টজনের পত্রসাহিত্য ভাণ্ডার। পত্রিকা অফিসে পত্রে মারফতই গল্প, কবিতা পৌঁছাত। মনে পড়ে জালিওয়ানাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কবির প্রতিবাদী চিঠি। আর জেল থেকে লেখা অসংখ্য বিপ্লবীর মণিমুক্তের মতো চিঠিপত্র। সবচেয়ে বড় কথা, দূরপথে আমজনতার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। জন্ম-মৃত্যুর, আনন্দ-বেদনার, ভালোবাসার চিঠি। এবং যৌবনের প্রেমপত্র। এক টুকরো কাগজ ও ঝর্ণা কলমে যৌনতার প্রথম কদমফুল! আড়াই দশক আগেও বাঙালি বাড়ির সদর দরজায় ডাকবাক্স ছিল অবধারিত। আজ অলীক মনে হয়! যা হোয়াটসঅ্যাপে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে হয়ে যায়, তার জন্য কে অপেক্ষা করবে দেড় কি দুই বা তিন মাস! চিঠির মৃত্যু মানে আসলে অপেক্ষার মৃত্যু!
দেহ রেখেছে রেডিও: চিঠির তুলনায় বয়সে তরুণ। ১৯২২ সালে ভারতে প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে ব্যাপক আকার ধারণ করে অল ইন্ডিয়া রেডিও। পরে রবীন্দ্রনাথের হাতে নামকরণ হবে ‘আকাশবাণী’। রেডিও মানে ভারতের সঙ্গে দুধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ, ম্যালকম মার্শাল বল করছে, ব্যাট করছে সুনীল গাভাসকর, আসমুদ্রহিমাচল কান দিয়ে দেখছে! ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। রেডিও মানে অনুরোধের আসর, বুধসন্ধ্যার যাত্রা, দুপুরে নাটক, শনিবারের বারবেলায় ভূতের কাহিনি, বিবিধভারতী, হিন্দি ও বাংলা গান, গীতা-লতা-আশা, হেমন্ত-মান্না-কিশোর-রফি…, ‘ন্যাকা’ দুপুরে বোরোলিনের সংসার, মায়াবী শ্রাবন্তী। এবং মহালায়। মহিষাসুরমর্দিনী। মাঝে মরেও বেঁচে উঠেছিল এফএম! তারপরও বাঁচানো গেল কি? শুধু বছরে একবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র—আশ্বিনের শারদ প্রাতে…’। ইউটিউবের যুগে কে পোঁছে! এখম দেখাই সব, অডিওর সঙ্গে লাগবেই ‘ভিসুয়াল’! “কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়…!”
গ্রন্থ আছে, গ্রন্থাগার থেকেও নেই: “বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত ভাবে আগামিকাল।” একথা এমনি বলেননি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আদিযুগের নেতা এবং বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক গোপাল কৃষ্ণ গোখলে। ডাকঘরের মতোই ভারতের প্রথম গ্রন্থাগারও প্রতিষ্ঠিত হয় এই বাংলায়। ১৮৩৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি। স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালে নাম হয় জাতীয় গ্রন্থাগার। শুধু কলকাতায় নয়, গোটা বাংলায় শিক্ষার কাণ্ডারী ছিল শহর ও গ্রামের অসংখ্য গ্রন্থাগারগুলি। বিভূতিভূষণের অপুই হোক কিংবা সত্যজিতের ফেলু মিত্তির। গ্রন্থাগারের পথেই বাঙালির আলোকযাত্রা এবং বিশ্ব অভিজ্ঞান। নিছক আনন্দও বটে। নিষিদ্ধ গ্রন্থের হাতছানিও। কত বিশিষ্ট জন যে বলেছেন—বই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। যিনি বলেছেন তিনি তো বটেই, বইয়ের ঠিকানা গ্রন্থাগারও ভূত হয়ে গিয়েছে কার্যত। সবচেয়ে বড় কথা, পাড়ায় পাড়ায় কিছু লাইব্রেরি আছে বটে। তাতে গ্রন্থও রয়েছে। কিন্তু পাঠক নেই। ওই যে ভূতের মতো একা অতীত পাঠ করছেন বুড়ো লাইব্রেরিয়ান!
অলীক সিনেমা হল: চিঠি, রেডিও, গ্রন্থাগারের মতোই ভূত হয়ে গিয়েছে সিনেমা হল। মাল্টিপ্লেক্সের যুগে প্রয়াত লাইটম্যান, ম্যাটিনি-ইভনিং-নাইট শো এবং ব্ল্যাকার। তাছাড়া গরমে বসে বসে কে খাবে ছারপোকার কামড়! সকাল এগারোটার দুষ্টু শো-ও অতীত। বাঙালি শিশু এখন মোবাইলে খায়, ‘বড়’ ও বুড়োও হয়! অথচ সিনেমা হলেও বাংলাই ছিল দিশারী। সাহেবদের উদ্যোগে কলকাতার শহরেই প্রথম বায়োস্কোপ দেখানো আরম্ভ হয়েছিল চৌরঙ্গি থিয়েটারে ১৮৯৭ সালের ১৮ জানুয়ারি। অথচ ভরত ভূষণ, বসন্ত চৌধুরী হয়ে উত্তম-সুচিত্রার হাউসফুল দিনকে আজ মনে হয় অলীক! সিনেমা হলেই তো কত প্রেম দানা বাঁধল। রেফারেন্স: বসন্ত বিলাপ। মনে আছে বাঙালির?
আড্ডা, বাট অ্যাট হায়েস্ট লেভেল: বাঙালির সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস? নাকি সবচেয়ে ভালো! একদিন তাহাদের ঘাড়ে ছিল আড্ডার ‘ভূত’। চায়ের দোকান থেকে কফিহাউজ, কলেজ ক্যান্টিন থেকে পাড়ার রক… সুনীল-শক্তি, কত টেনিদা, ঘনাদার জন্ম! দু’জন কী চারজন বাঙালি এক হলেই আড্ডা, চা ও টা…। তারপর পিকনিক, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, এমনকী লিটল ম্যাগাজিন…। যদিও ‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়…’। তথাপি সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক ছবিতে গ্রিসের সর্বোত্তম আড্ডার কথা ওঠে। রবীন্দ্রনাথ কখনও আড্ডা মেরেছিলেন? সেই প্রশ্নও তোলেন মনোমোহন মিত্রের চরিত্রে অভিনয় করা ‘ভবঘুরে’ উৎপল দত্ত। এই প্রশ্ন-উত্তরের সিকোয়েন্স ছবিতে। আশ্চর্য… সেও এক আড্ডার দৃশ্য! কিন্তু সে তো ১৯৯১-এর ছবি। পয়ত্রিশ বছর পর বাঙালির আড্ডা মারে না আর। সময় পায় না। সময় নিয়ে গেছে চিলে। চিলের পিছনে পিছনে ছুটতে দিন কেটে যায়! সূর্যাস্ত নামে শপিং মলের পিছনে…।
এই অন্য ভূতচরিতের তালিকা দীর্ঘ। আপাতত কেবল মনে করানো যেতে পেরে। যেমন, উঠোন, লোডশেডিং, অ্যান্টেনা, এসডিটি বুথ, রেকর্ড প্লেয়ার, ভিসিডি, ক্যাসেট, ফ্লপি, কলতলা, পুকুরপাড়, খেলার মাঠ, ঘুঁটে, কয়লা, উনুন ইত্যাদি ইত্যাদি…। এর মধ্যে কিছু জিনিস অবশ্যি গ্রামের দিকে টিকে আছে টিমটিমে হ্যারিকেনের মতো। কিন্তু খুব ভয়ে ভয়ে। কখন প্রাণ কেড়ে নেয় নির্মম আধুনিকতা! মানে সময়ের ব্ল্যাকহোল!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.