Advertisement
Advertisement
Dear Maa Review

রক্তের সম্পর্ক না ভালোবাসার মায়া? নারীমনের গহীনে ডুব ‘ডিয়ার মা’য়ের, পড়ুন রিভিউ

কেমন হল অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি পরিচালিত 'ডিয়ার মা'?

Jaya Ahsan, Chandan Roy Sanyal starrer Dear Maa Review
Published by: Sandipta Bhanja
  • Posted:July 19, 2025 3:50 pm
  • Updated:July 19, 2025 4:03 pm   

শম্পালী মৌলিক: বাচ্চাটা গড়াচ্ছে। গড়াতে গড়াতেই জিজ্ঞেস করছে, ‘আমার মা কোথায়? ’ উল্টোদিকের মানুষটা বলছে, ‘আমি তাহলে কে?’ ফের খুদে বলছে, ‘তুমি তো আমার মা না মামমাম’। প্রশ্ন আসে, মামমাম কি মা না? কচিটা বলে, ‘আসল মা?’ বুকের ভিতরে চিনচিন ব‌্যথা লাগে। মা হওয়া কেমন? দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করা? নাকি পিঠে-বুকে-মাথায় সমস্ত অস্তিত্বে ধারণ করা যেভাবে, সেটাই মাতৃত্ব। প্রশ্নটা ঘুর পাক খায় মাথায়। বড় যত্নে, অনেক মায়া দিয়ে ‘ডিয়ার মা’ ছবিটা করেছেন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি।বেশ কয়েক বছর পর তিনি বাংলা ছবি পরিচালনায়। এ কথা নিশ্চিত বলা যায়, দর্শক আশাহত হবেন না।

Advertisement

অনিরুদ্ধর ছবিতে মানব চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন সবসময় প্রাধান‌্য পেয়েছে, এ ছবিও তার ব‌্যতিক্রম নয়। আধুনিক সময়ের গল্প বলেছেন তিনি, যেখানে দৃশ‌্যের পর দৃশ‌্য গাঁথা ব‌্যথা-দীর্ণ-কাব‌্যময়তায়। এক নারী, তার স্বামী এবং সন্তানকে ঘিরে গল্প। প্রতিফলিত হয় সমাজের মানসিকতা। ছবিটা শুরুর একটু পরেই মনে ধরে যায়। শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন ব‌্যাকড্রপে ‘এত বেশি কথা বলো কেন/চুপ করো, শব্দহীন হও’– যেখানে আমরা দেখি অর্ক (চন্দন রায় সান‌্যাল) ড্রয়িং রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারারাত জেগে কাজ করেছে বৃন্দা (জয়া আহসান)। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে তারা পরস্পরের মুখোমুখি। কফি হাতে তারা ভোর থেকে সকালের দিকে। অর্ক সন্তান চায়। বৃন্দা চায় না। কাজ তার ধ‌্যানজ্ঞান। বাচ্চা হলে তাকে কেরিয়ারে আপোস করতে হবে, যেখানে সে রাজি নয়।ধরেই নেওয়া হয়, সন্তানের জন্ম মানে মাকেই তার নিজের জীবন-সংসার সামলে বাচ্চার দেখভাল করতে হবে। এক্ষেত্রে বৃন্দা সম্পূর্ণ বিপরীত। তাহলে অর্ক কি স‌্যাক্রিফাইস করবে? শুরু হয় দ্বন্দ্ব। আমরা দেখি গাড়ির স্টিয়ারিং বৃন্দার হাতে। তাদের প্রেমের বিয়েতে ভালোবাসা বেঁচে অনেক, ফলত সংঘাত পেরিয়ে কন‌্যা দত্তক নেয় তারা। বাবা হতে পেরে অর্ক ভীষণ খুশি। বেরিয়ে আসে তার ভিতরের ‘মাদারহুড’। অন‌্যদিকে কর্মব‌্যস্ত বৃন্দা মেয়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করলেও কোথাও যেন ঝিমলি-র (ছোট্ট অহনা) সঙ্গে তার ব‌্যবধান রয়ে যায়। বাবি আর ঝিমলির যে সখ‌্য তেমন সেতুবন্ধন অধরা রয়ে যায় বৃন্দা আর কন‌্যার মধ‌্যে। আত্মপ্রত‌্যয়ী নারীর ভিতরেও সন্তানের সঙ্গে এই দূরত্ব তৈরি করে এক অনিবার্য নিরাপত্তহীনতা। এমন সময় অর্কর অনুপস্থিতিতে ফাঁকটা আরও বাড়ে।ততদিনে কিশোরী ঝিমলি (নন্দিকা দাস) খোঁজ পেয়েছে তার আসল মায়ের (পদ্মপ্রিয়া জানকীরমন)। এই সমস্ত উথালপাতাল সময়ে বৃন্দার ধ্রুব-সমর্থন হয়ে থাকে গৃহসহায়িকা নির্মলা (অনুভা ফতেপুরিয়া)। আগলে রাখে মা-মেয়েকে। আর প্রায় বিবেকের ভূমিকায় বৃন্দার পাশে থাকে কলেজের স‌্যর সোমেশ (ধৃতিমান চট্টোপাধ‌্যায়)। মা-মেয়ের জীবন চলছিল, কিন্তু হঠাৎ সোহিনী (ঝিমলির ভালো নাম) উধাও হয়ে যাওয়ায় সংকট সামনে এসে পড়ে। অবধারিত থানা-পুলিশ। তদন্তকারী অফিসারের (শাশ্বত চট্টোপাধ‌্যায়) সামনে বৃন্দার আকুল আবেদন মেয়েকে খুঁজে পেতে চেয়ে, অন‌্যদিকে কিছু তথ‌্য গোপন। যে কোমল ‘মামমাম’ বৃন্দাকে দর্শক এতক্ষণ দেখেনি– এবার তার উদ্বেগ, তীব্র ভালোবাসা, প্রকাশ করতে না পারা, সবকিছু সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে থাকে সময়ের কাছে। যে সময়ে সন্তান আর কাজই তার একমাত্র আশ্রয়। সে তো তাকিয়ে থাকত মেয়ের সঙ্গে হট চকোলেট খাওয়ার একটা বিকেলের দিকে। বাবার মতো মেয়েকে গায়ে মাখেনি বলে, সে কি জানে না এক বিছানায় থাকা ঝিমলির নিঃশ্বাসের ওম? মেয়েও তো জানে পিরিয়ডস-পেন-এ মায়ের হটব‌্যাগ সে-ই এগিয়ে দেবে। দুই মায়ের উপস্থিতি নড়ে যায় কচিমন। অনিবার্য প্রশ্ন রক্তের সম্পর্ক না ভালোবাসার টান? কিশোরী মেয়ের অন্বেষণে গল্প ক্লাইম‌্যাক্সের দিকে এগোয়। এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই চিত্রনাট‌্যে। ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবে তা ফ্ল‌্যাশব‌্যাক আর বর্তমান সময়কে নিয়ে বৃন্দা মা হয়ে ওঠার বৃত্তের দিকে এগোয়। একটা চমৎকার সংলাপ আছে শেষদিকে। বৃন্দা বলে– ঝিমলি ভালোবাসতে চেয়ে কাঁদত। আর ভালোবাসতে না পেরেও কাঁদত। এ হল মায়ের উপলব্ধি। রক্তসম্বন্ধ তো টানবেই। তাই বলে ভালোবাসার জোর কি কিছুমাত্র কম? ‘ডিয়ার মা’ সেই কথাই বলে।

বৃন্দার চরিত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন জয়া আহসান। কেরিয়ারিস্ট নারীর ভূমিকায়, পালিতা মায়ের চরিত্রে, তিনি অবর্থ‌্য। অন‌্যদিকে স্বামীর সঙ্গে সোহাগে কিংবা সন্তানের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক‌্যবিনিময়ে তিনি অবিকল্প ‘ডিয়ার বৃন্দা’। চন্দন এতই এফর্টলেস অভিনয় করেছেন তাঁর দশে দশ প্রাপ‌্য। অনুভা ছবির আরেক স্তম্ভ। ভীষণ ভালো লাগে ধৃতিমান চট্টোপাধ‌্যায়কে। এই বয়সে তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স, বাচনভঙ্গি মুগ্ধ করে। শাশ্বত একবারও ক‌্যামেরার দিকে সরাসরি না-তাকিয়ে প্রায় স্রেফ অভিব‌্যক্তি আর বাচনভঙ্গি দিয়ে মাত করেছেন। অল্প স্ক্রিন টাইমে ভালোই লাগে পদ্মপ্রিয়া এবং সায়ন মুন্সিকে। তবে বলতেই হবে এ ছবির দুই ‘লিট্‌ল স্টার’-ই আসল নক্ষত্র। ছোট্ট অহনা চলতে-ফিরতে-হাসতে-হাসতে ছবির নিউক্লিয়াসটা ধরে নিল। সাবাশ খুদে! দারুণ লাগে তার কিশোরীবেলার চরিত্রে নন্দিকাকে। রাগে, আদরে-আবদারে সে রক্তমাংসের হয়ে উঠেছে। প্রথমবারেই দুজনের এই কাজ ভাবা যায় না! বিক্রম ঘোষের সুরারোপিত গানগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগে। অভীক মুখোপাধ‌্যায়ের ক‌্যামেরা বরাবরের মতোই মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে। পরিচালক অনিরুদ্ধ আর শাক‌্যজিতের চিত্রনাট‌্য একটা বহুদিন মনে থেকে যাওয়ার মতো ছবি উপহার দিল দর্শককে। একটাই অনুযোগ একাধিক হিন্দি গানের ব‌্যবহার বাংলা ছবিতে। হয়তো সর্বভারতীয় দর্শকের কথা মাথায় রেখেই করা। এই সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখার। ছবিটা দেখলে মনে হয়, সময় থাকতে কিছু কথা স্পষ্ট উচ্চারণে বলে দেওয়া ভালো। না-বলা কথা স্রেফ দূরত্ব বাড়ায়।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ