বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: যেকোনও ক্রাইম ড্রামা তখনই সফল হয়ে ওঠে যখন দর্শক দেখতে দেখতে নিজেও দ্বন্দে এবং টেনশনে পরে ভাবতে থাকেন, আসল অভিযুক্তকে ধরা যাবে তো! সমাধানের পথ যত প্যাঁচালো, রহস্য তত টানটান। এবং সেটা তখনই সম্ভব যখন চিত্রনাট্য হয় বিশ্বাসযোগ্য এবং টানটান। বাংলা ক্রাইম ড্রামা সেই দিকে ততটাও কী পারদর্শী হয়ে উঠতে পারল? সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ সিজন টু’। একাংশ দর্শক প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আছে সত্য ঘটনার ছায়া। পঙ্কজ ত্রিপাঠী অভিনীত ওয়েব সিরিজ ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস’-এর আদলে তৈরি ‘অচিন্ত্য আইচ’ এক মধ্যবিত্ত সাধারণ আইনজীবীর কেস স্টাডি বলা যায়। এক আন্ডারডগ-এর গল্প যে কিনা আন্ডারডগদের হয়েই লড়াই করে। স্মার্ট দুঁদে উকিল বলতে যা বোঝায় তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে এই কেরানিসুলভ, এক্কেবারে সাধারণ অচিন্ত্য। এই ধরনের কমনম্যানের গল্প যখনই দেখি, তা আমাদের শহুরে-সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর জীবনে—– মেধা, বুদ্ধিজীবী, স্মার্টনেসের সংজ্ঞাকে বারবার চ্যালেঞ্জ করে। অ্যাকাডেমিক শিক্ষা আর মননশীলতা ও সংবেদনশীলতা যে এক নয় এই সিরিজ তা বারবার মনে করিয়ে দেয়। একটু কম স্মার্ট, স্বল্প শিক্ষার মানুষ একজন ডিগ্রিধারী মানুষের চেয়েও সংবেদনশীল হতে পারে, যেমন অচিন্ত্য। তবে মনে রাখা দরকার ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’ একটি ক্রাইম ধর্মী সিরিজ যেখানে সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি চাই বিনোদন, রুদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্য। কেবলই বার্তাময় হয়ে উঠলে, উত্তেজনা তৈরি হয় না। দ্বিতীয় সিজন দেখতে গিয়ে সেটা বারবার মনে হয়েছে।
কেন তা একটু বিশদে বলা প্রয়োজন। এবারের কেস এমন যার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার মিল রয়েছে। যেমন হেতাল পারেখ মার্ডার কেস। মনে পড়তে পারে আরুশি মার্ডার কেস এবং অভয়ার ঘটনার স্মৃতিও। কারণ প্রথমত প্রোটেস্ট মার্চ দিয়ে সিরিজ শুরু হয়। যেখানে ‘বিচার চাই’, ‘অভিযুক্তের ফাঁসি চাই’, ধর্মী স্লোগান শোনা যায়। অভয়ার ঘটনার পর আমরা যারা আবেগের বশে, পথে মিছিল করেছি তাদের অনেকাংশ হতাশায় নিজেদের সরিয়ে নিয়েছি। ফলে স্ক্রিনে এমন প্রোটেস্ট মার্চ তেমন ইমপট্যাক্ট তৈরি করে না। গল্প যত এগোয়, মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারি, এটা অভয়ার গল্প নয়। অন্যদিকে আরুশি মার্ডার কেস বা হেতাল পারেখের কেসে বিচার নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে, আছে নানান স্তর এবং জটিলতা। আসল অভিযুক্ত ধরা পড়েনি এমন থিওরিতে বিশ্বাস করেন অনেকেই। এই সিরিজে তার মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে গল্প দাঁড় করানো হয়েছে। যেখানে উচ্চবিত্ত পরিবারে কর্মচারীর (অভিনয়ে সত্যম ভট্টাচার্য) প্রতি অন্যায় হওয়া থেকে তাঁকে বাঁচানোও হল অন্যদিকে বাবা মাকে অনার কিলিং-এর কালিমা থেকেও বাঁচানো হল মাতৃত্বের কার্ড ব্যবহার করে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। এবং সমাধান হল খুব দ্রুত গতিতে। খুব কঠিন পরিস্থিতিও খুব সহজে পার হয়ে গেল অচিন্ত্য। অচিন্ত্যের সহকর্মী ভীমের ক্লু পেতে কোনও অসুবিধে হয় না। ভীমের চরিত্রে দেবরাজ ভট্টাচার্যর একটা দৃশ্য মনে থেকে যায়, যেখানে সে বৃহন্নলা অথবা রূপান্তরকামীর ছদ্মবেশে উপস্থিত হন।
অচিন্ত্যও সিকিউরিটি ঘেরা বহুতলে ঢুকে পড়ে চোখের নিমেষে। ক্লু জোগাড় করা এত সহজ হলে সাসপেন্স তৈরি হবে কি করে? অন্যদিকে নারীর উপর হিংসা, বর্তমানে পকসো আইন এই সব নিয়ে নানা তথ্যে দর্শকদের অবগত করানো হয়। সেসব ঠিক আছে। এখানে অভিযুক্ত পুরুষটি নির্দোষ, তাই অচিন্ত্যের আগমন। কিন্তু আমরা যদি ফ্যাক্ট চেক করি সেখানে সংখ্যাতত্ত্ব অন্য কথা বলবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীর ওপর পুরুষের ভায়োলেন্সের হার অনেক বেশি। একদিকে অচিন্ত্য, অন্যদিকে পকসো আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী (অভিনয়ে সোহিনী সেনগুপ্ত)। এমন একটা আইনি লড়াই নারী বনাম পুরুষ হয়ে উঠতেই পারত, যেখানে অচিন্ত্য জিতে গেলে পুরুষের জয়– এমন একটা ন্যারেটিভ তৈরি হতে পারত, কিন্তু সেটা হয়নি। পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তীর এখানে প্রশংসা প্রাপ্য। চিত্রনাট্যকার সচেতন ভাবে সেই চেষ্টা করেছেন যাতে কোনওভাবেই এই সিরিজ ‘ব্যাটেল অফ সেক্সেস’ না হয়ে ওঠে। ‘সন্তান’-এর মতো জেন্ডারলেস শব্দবন্ধের ওপর জোর দিয়েছেন। এবং ঋত্বিক চক্রবর্তীর উপস্থিতি ও অভিনয় সেটাকে ফিনিশিং টাচ দিয়েছে। এবারের অচিন্ত্য আইচ দর্শক হিসেবে আমাকে এই ভরসাটা অন্তত দিতে পেরেছে যে চাইলেই বিতর্কিত সাবজেক্ট নিয়ে সংবেদনশীলতার সঙ্গে একটা ডায়লগ তৈরি করা যায়। না হয় রহস্য কম পড়ল – কিন্তু সেনসেশন তৈরি করে লড়িয়ে দেওয়া তো খুব সহজ, শান্তিস্থাপন করা অনেক বেশি কঠিন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.