সুজন কুমার দাস: স্পষ্টভাবে বলুন, ‘হ্যাঁ, এটা দরকার।’
বেশ মনে পড়ে, ছোটবেলায় বাবার কাছে মুখ ফুটে চাইতে পারিনি বলে কত ছোট-ছোট সাধ অপূর্ণই রয়ে গিয়েছে। স্কুলের টিফিন আওয়ারে সেই ‘স্পেশাল আলুর দম’ কেনার পয়সাটা বাবাকে চাইতে পারিনি। আলুর দম খাবার তীব্র বাসনা অন্তরেই ‘দমত্যাগ’ করেছে। তারপর বড় হয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে জানলাম, অর্থনীতিতেও চাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। বাজারে সরবরাহ তৈরি হয় তখনই, যখন ভোক্তারা স্পষ্টভাবে চাহিদা প্রকাশ করে। তাই চাইতে শেখা শুধু ব্যক্তিগত উন্নতি নয়, সমগ্র অর্থনীতিরও চালিকাশক্তি।
আমাদের জীবনে ‘চাওয়া’ এক অদ্ভুত শক্তি। ছোটবেলায় আমরা চাই খেলনা, লোভনীয় খাবার, বন্ধুদের সঙ্গ ইত্যাদি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই চাওয়ার ধরন পাল্টে যায়– চাকরি, সম্পর্ক, অর্থ, সাফল্য। কিন্তু সমস্যা হল, সবাই চাইতে জানে না। কেউ দ্বিধা করে, কেউ আবার ছোটখাট চাওয়াতেই আটকে যায়। ফলে অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়। কত আবেগভরা হৃদয়ের ‘চাওয়া’ শুধু না-বলতে পারার কারণে নীরবে, নিভৃতে অশ্রু হয়ে ঝরে গিয়েছে, অব্যক্ত প্রেম নিভে গিয়েছে অকালেই। অসংখ্য সাহিত্যিক মুখ ফুটে প্রকাশকের কাছে প্রাপ্য ন্যায্য ‘রয়্যালটি’ চাইতে না-পারায় চরম দারিদ্র্যের আঘাতে তাঁদের সৃষ্টির কলম থেমে গিয়েছে। তাই চাইতে শেখা খুব জরুরি। চাওয়ার মধ্যে এক ধরনের আর্ট আছে। যেমন, দুধের শিশুদেরও মায়ের দুধ চাইতে হয়– তাদের ভাষা কান্না।
ধরুন, আপনি একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মী। কিন্তু বছরের শেষে দেখলেন, বেতন বাড়েনি। কেন? কারণ আপনি কখনও স্পষ্ট করে বসকে বলেননি, ‘আমার বেতন বৃদ্ধির সময় হয়েছে।’ ভেবেছিলেন, তিনি নিজে থেকেই বুঝবেন। কিন্তু পৃথিবী এভাবে কাজ করে না। শুধু ‘ভাল’ কর্মী হলেই হয় না, আপনাকে হতে হবে সচেতন দাবিদারও। কারণ, চাওয়ার মধ্যেই শুরু হয় প্রাপ্তির পথ।
চাওয়া তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। ব্যক্তিগত স্তরে চাইতে হয় পরিবার, বন্ধু বা সঙ্গীর কাছে। আমরা প্রায়ই ধরে নিই, তারা আমাদের মনের কথা বুঝে নেবে। কিন্তু সেটা হয় না। যদি অসুস্থ থাকেন, সরাসরি বলুন, ‘আজ আমার শরীর ভাল নেই, একটু সাহায্য করো।’ যদি সম্পর্কে অবহেলিত বোধ করেন, স্পষ্টভাবে বলুন, ‘আমি চাই তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোনো।’ এতে সম্পর্ক আরও স্বচ্ছ হয়। পেশাগত স্তরে, বস বা সহকর্মীর কাছে বেতনবৃদ্ধি বা নতুন দায়িত্ব স্পষ্টভাবে দাবি করতে হবে। অনেকেই কাজ করেন, কিন্তু সুযোগ না-চাইলে প্রতিভা চাপা পড়ে যায়। আধ্যাত্মিক স্তরে, চাওয়ার মানে নিজের মন বা মহাবিশ্বের কাছে আবেদন করা। শুধু কল্পনা নয়, বরং লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা এবং তার জন্য কাজ করাই এখানে মূল কথা।
চাওয়ার কিছু মূল নিয়ম আছে। প্রথমত, যখনই আমরা কিছু চাই, তখনই ভেতরের ও বাইরের শক্তি কাজ শুরু করে। যেমন একটি বোতাম টিপলেই মেশিন চালু হয়—– চাওয়া হল সেই বোতাম টেপা। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে সুযোগ বা সম্পদ কম নয়, আমরা প্রায়ই চাই না বলেই পাই না। তৃতীয়ত, সাফল্য সীমাহীন– এটা সমুদ্রের মতো বিশাল। কিন্তু আমরা অনেকে সেই সমুদ্র থেকে জল তুলতে যাই ছোট চামচ নিয়ে। দরকার অন্তত একটি বালতি।
চাওয়ার দু’টি মূল কৌশল আছে– প্রথমত, ‘লক্ষ্য’ যেন পরিষ্কার ও নির্দিষ্ট হয়। কারণ লক্ষ্য যত স্পষ্ট হবে, তত সহজে তা অর্জনের পথ তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত, চাইতে হবে শিশুর মতো অটল বিশ্বাস নিয়ে, যে চাইলে পাওয়া যাবে। তবে পরিকল্পনা করতে হবে প্রাপ্তবয়স্কের মতো– গোছানো ও বাস্তবসম্মত।
এ-ই প্রসঙ্গে গণতন্ত্রের কথাও জরুরি। গণতন্ত্র আসলে এক বিশাল চাওয়ার মঞ্চ। জনগণ চায়, আর রাজনীতিক ও প্রশাসন সেই চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু নাগরিকরা কি ঠিকভাবে চাইতে শিখেছে? আমরা অনেক সময় শুধু বলি ‘পরিবর্তন চাই’, কিন্তু স্পষ্ট করি না– শিক্ষায় কী পরিবর্তন, স্বাস্থ্য বা কর্মসংস্থানে কী ধরনের পরিবর্তন। অনেকে আবার শুধু ছোট সুবিধার কথা তোলে– ভাতা, রেশন, চাকরির সুপারিশ– কিন্তু বড় নীতি নিয়ে দাবি করে না। ফলে রাজনীতিকরা ছোট প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নেয়, কিন্তু বড় সমস্যাগুলি থেকেই যায়। যদি নাগরিকরা স্পষ্টভাবে চাইতে শেখে, তবে রাজনীতিকরা জবাবদিহি করতে বাধ্য। যেমন, যদি সবাই একসঙ্গে স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নের দাবি তোলে, সরকার নতুন হাসপাতাল গড়তে বাধ্য হয়। যদি কর্মসংস্থানকে মূল ইস্যু বানানো যায়, রাজনৈতিক দলগুলোও কর্মসংস্থানের রূপরেখা দিতে বাধ্য। গণতন্ত্রে চাইতে শেখা মানে শুধু ব্যক্তিগত লাভ নয়, বরং সমষ্টিগত কল্যাণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা।
চাওয়ার গুরুত্ব কেবল ব্যক্তি বা রাজনীতিতেই সীমিত নয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিকেও তার প্রভাব আছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও চাওয়ার কৌশল অপরিহার্য। শিক্ষার্থীরা যদি প্রশ্ন করতে না জানে, তবে জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আবার সুযোগ বা বৃত্তি চাইতে না পারলে অনেকেই পিছিয়ে পড়ে। চাওয়ার শিক্ষা মানে আত্মবিশ্বাস তৈরি।
হালে সোশ্যাল মিডিয়া নতুন চাওয়ার মঞ্চ হয়ে উঠেছে। হ্যাশট্যাগ আন্দোলন যেমন ‘#MeToo’ বা পরিবেশ রক্ষার প্রচেষ্টা দেখিয়েছে, স্পষ্ট দাবি তুললে বিশ্ব সাড়া দেয়। প্রযুক্তি চাওয়ার কণ্ঠস্বরকে আরও জোরালো করেছে।
চাওয়ার ভিতর সাহসও আছে। প্রত্যাখ্যানের ভয় আমাদের পিছিয়ে দেয়। আমরা ভাবি– চাইলাম, যদি না মেলে? কিন্তু না চাওয়ার ফলে নিশ্চিতভাবে কিছুই পাওয়া যায় না। অথচ চাইলে অন্তত সম্ভাবনা তৈরি হয়। জীবনের বহু দরজা এভাবেই খুলে যায়। সুযোগের হাতছানি আমরা পাই কেবল চাওয়ার সাহস দেখালে। আসলে, চাইতে পারা মানেই জীবনের সঙ্গে সক্রিয় সম্পর্ক গড়ে তোলা। আপনি নিজের চাহিদাকে স্বীকার করছেন, অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন, এবং সম্মিলিতভাবে সমাধান খুঁজছেন। যিনি চাইতে পারেন– তিনি আত্মবিশ্বাসী, সাহসী ও সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধ। আর যিনি চাওয়াকে চেপে রাখেন, তিনি ধীরে-ধীরে একাকী হয়ে পড়েন।
সবশেষে বলা যায়, চাইতে শেখা মানে শুধু কথার খেলা নয়– এটা জীবনের এক মৌলিক দক্ষতা। ব্যক্তিজীবনে চাইতে শেখা মানে নিজের স্বপ্নকে বাস্তব পথে চালিত করা, আর গণতান্ত্রিক জীবনে চাইতে শেখা মানে সমষ্টিগত উন্নতির জন্য চাপ সৃষ্টি করা। চাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আমাদের সবারই শেখা উচিত– চাইতে হবে বুদ্ধিমত্তার ও বিশ্বাসের সঙ্গে, আর চাইতে হবে বড় আকারে। তাহলেই সাফল্য, সুযোগ আর পরিবর্তন একদিন আমাদের হাতের মুঠোয় ধরা দেবে। তাই ভয় বা দ্বিধা নয়, আমাদের শেখা উচিত স্পষ্টভাবে বলা– ‘হ্যাঁ, আমার এটা দরকার।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.