Advertisement
Advertisement

Breaking News

Sikkim Landslide

রাগ করেছে পাহাড়! কোন বিপদের ঘণ্টাধ্বনি সিকিমে?

সিকিমের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি প্রকৃতির এক নির্মম সতর্কবার্তা!

Sikkim disaster an eye opener for things yet to come
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 6, 2025 5:13 pm
  • Updated:June 6, 2025 5:14 pm  

২০২৩-এর আকস্মিক হ্রদস্ফীতি কিংবা ২০২৪ সালের বিধ্বংসী ভূমিধস ও বন্যার কথা আমরা এখনও ভুলিনি। সেই আতঙ্কের রেশ কাটতে না কাটতেই ২০২৫-এ সিকিম আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে। সিকিমের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য শুধুমাত্র প্রকৃতির খেয়ালিপনা দায়ী নয়। বরং মানুষের অবিবেচনামূলক কার্যকলাপ বহুলাংশে দায়ী। কলমে বুদ্ধদেব হালদার

 

৮৯৮ সালে ‘The Atlantic Monthly’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ ও সংরক্ষণবাদী জন মুইরের একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। ‘The Wild Parks and Forest Reservations of the West’ নামক এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন-“Thousands of tired, nerve-shaken, over-civilized people are beginning to find out that going to the mountains is going home; that wildness is a necessity; and that mountain parks and reservations are useful not only as fountains of timber and irrigating rivers, but as fountains of life.” যার সহজ অর্থ করলে দাঁড়ায়, বিধ্বস্ত মানুষের একমাত্র শেষ আশ্রয় হল পাহাড়। পাহাড় আসলে সেই নিরাপদ ও নিরাময়কারী আশ্রয় যাকে জন মুইর উল্লেখ করেছিলেন মানুষের ‘বাড়ি’ হিসেবে। আত্মিক শান্তি ও স্বস্তি নিয়ে মানুষ যেমন দিনের শেষে বাড়ি ফিরে যায়। পাহাড়ের কাছে এলেও সেই একই অনুভূতি কাজ করে। পাহাড়ের নিকটে এলে সমস্ত অশুভ ও ক্লান্তি মুছে যাওয়ার কথা বলে গেছেন আমাদের প্রিয় কবিও। ‘সিন্ধুসারস’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান’।

সবুজে মোড়া ঢাল, মেঘে ঢাকা চূড়া, আর কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। এক অপরূপ স্বপ্নের জগৎ। ‘পাহাড়’ শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে একরাশ স্নিগ্ধতা জেগে ওঠে। অথচ সেই পাহাড়ই আজ আমাদের কাছে ভয়ের অন্য এক প্রতিরূপ। সিকিমের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি সেই নির্মমতাকেই যেন তুলে ধরে। ২০২৩-এর আকস্মিক হ্রদস্ফীতি কিংবা ২০২৪ সালের বিধ্বংসী ভূমিধস ও বন্যার কথা আমরা এখনও ভুলিনি। সেই আতঙ্কের রেশ কাটতে না কাটতেই ২০২৫-এ সিকিম আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে। মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আর ধসে বিপর্যস্ত গোটা রাজ্য। সেখানে সাম্প্রতিক কালে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ‘বিপর্যয় কবলিত’ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে উত্তর সিকমকে। মঙ্গন জেলার লাচেন, চাটেনে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি। হড়পা বান ও ভূমিধসজনিত কারণে পরিস্থিতি আরও একবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সিকিম প্রশাসন। লাগাতার ভারী বৃষ্টিপাত, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজ, এবং পাহাড়ের ঢাল কেটে তৈরি হওয়া রাস্তাঘাট সিকিমের ভঙ্গুর পরিবেশকে আরও বিপন্ন করে তুলেছে। তিস্তা নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বহু বাড়িঘর, রাস্তা ও কাঠের সেতু। ধস ও ভারী বর্ষণের জেরে দক্ষিণ সিকিম থেকে উত্তর সিকিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন। পর্যটকরা আটকে পড়েছেন বিভিন্ন স্থানে। মৃত্যুর খবর আসছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়েছে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে। স্থানীয় অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে, যা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগে যাবে বেশ কয়েক বছর।

সিকিমের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য শুধুমাত্র প্রকৃতির খেয়ালিপনা দায়ী নয়। বরং মানুষের অবিবেচনামূলক কার্যকলাপ বহুলাংশে দায়ী। এর মধ্যে পর্যটকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নিঃসন্দেহে পর্যটন শিল্প সিকিমের অর্থনীতির চালিকা শক্তি, কিন্তু এর অকল্পনীয় বৃদ্ধি পাহাড়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে ক্রমাগত। দিন দিন পর্যটকদের ভিড় বাড়ার সাথে সাথে পাহাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, রিসর্ট, হোমস্টে। এই নির্মাণ কাজগুলো প্রায়শই পাহাড়ের ঢাল কেটে করা হয়, যা ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ। পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক, খাবারের প্যাকেট এবং অন্যান্য বর্জ্য পাহাড়ের পরিবেশকে ক্রমাগত দূষিত করে চলেছে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে এই আবর্জনাগুলি বৃষ্টির জলের সাথে নদীতে মিশে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। অন্যদিকে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে চলায় গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছে। তাই সিকিমের বন্যাপরিস্থির জন্য আমরা নিজেদের দায় কখনওই এড়িয়ে যেতে পারব না। সিকিমের এই বিপর্যয় আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করে চলার গুরুত্ব আমাদেরকে এখনই উপলব্ধি করতে হবে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ সিকিম প্রশাসনকে গ্রহণ করতে হবে। পর্যটন শিল্পের লাগামহীন দৌড় বন্ধ করতে হবে। পরিবর্তে একটি সুসংহত ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা দীর্ঘমেয়াদে বাস্তুতন্ত্র-বান্ধব হবে। নতুন প্রকল্প অনুমোদন করার আগে পরিবেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। পর্যটক এবং স্থানীয় উভয়ের মধ্যেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। পাহাড়ের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিবহাল করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হতে শিখলে বিপর্যয় এড়ানো আরও কঠিন হয়ে উঠতে বাধ্য। ইকো-ট্যুরিজম, কমিউনিটি-বেসড ট্যুরিজম-এর মতো বিকল্প পর্যটন মডেলগুলিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উন্নত প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো ব্যবহার করা প্রয়োজন।

সিকিমের বর্তমান পরিস্থিতি প্রকৃতির এক নির্মম সতর্কবার্তা। আমরা যদি এখনও সচেতন না হই, কিংবা প্রকৃতির উপর আমাদের অবিবেচনামূলক পদক্ষেপ বন্ধ না করি, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পাহাড় কেবল একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়। এটি একটি জীবনধারণের আশ্রয়, একটি বাস্তুতন্ত্র, এবং ভবিষ্যতের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতির সাথে সদ্ভাব রেখে চলা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement