হিমবাহের গলন ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। ১৯৬১ সালের পর থেকে ৯৬০ কোটি টন হিমবাহের বরফ গলেছে। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’-এর আশঙ্কা, এমন চলতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর সমস্ত হিমবাহের এক-তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমরা ওয়াকিবহাল? ধরালি, চামোলি, কেদারনাথ এপিসোড কিন্তু তা প্রমাণ করে না। লিখছেন চিরঞ্জীব রায়।
৫ আগস্ট, মঙ্গলবার। দুপুর দেড়টা। বজ্র নেই, বৃষ্টি নেই, উত্তরাখণ্ডের ধরালিতে আচমকাই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এল কাদা-পাথরের দুর্নিবার স্রোত। তুমুল বান ডাকল ক্ষীরগঙ্গায়। ধুয়েমুছে গেল নদীর একটি পাশের জনপদের অর্ধেকটা। নিখোঁজ হলেন শতাধিক মানুষ। ৫ বছর আগে উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে একইভাবে ঋষিগঙ্গা ও ধৌলিগঙ্গায় নেমে আসা হড়পা বানে নিখোঁজ হয়ে, প্রাণ হারিয়েছিল ২০০-র বেশি মানুষ। এই সংখ্যা ‘মাত্র’ মনে হবে– যদি আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া যায়।
২০১৩ সালে, দেশের অন্যতম মর্মান্তিক দুর্যোগে, কেদারনাথে মৃতের সংখ্যা ৬ হাজার ছাপিয়ে গিয়েছিল। বিপর্যয়ের মাত্রা ভিন্ন হলেও কারণটা সর্বত্র একই। হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হ্রদ ছাপিয়ে গিয়ে বিশাল জলরাশির হঠাৎ নেমে আসা ও বন্যা ঘটানো। কারণ, হাড়হিম করে দেওয়া হারে হিমবাহ গলছে। হিমালয় বিপন্ন। শুধু হিমালয়ই নয়, আবহাওয়া বদলের জেরে এই নিঃশব্দ অথচ ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বই বিপন্ন।
‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ বা ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন’– আধুনিক থেকে আধুনিকতর হতে থাকা মানব সভ্যতার এক অনিবার্য অবদান। আরও আরও আরও সুখ খুঁজতে গিয়ে কল-কারখানা বাড়ছে, যানবাহন বাড়ছে, জ্বালানি পুড়ছে। সভ্যতাকে জায়গা ছেড়ে দিতে গিয়ে বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা। পরিবেশে তাপ বন্দি হয়ে থাকছে, দিন-প্রতিদিন উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠছে পৃথিবী। প্রতি দশকে তাপমাত্রা বাড়ছে গড় ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড করে।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ইউনিভার্সিটি ২০১৯ সালে উপগ্রহ মারফত এক সমীক্ষা করে। তাতে পাওয়া তথ্য যথেষ্ট উদ্বেগের। দেখা যাচ্ছে, ১৯৬১ সালের পর থেকে ৯৬০ কোটি টন হিমবাহের বরফ গলেছে। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’-এর আশঙ্কা, এমন চলতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর সমস্ত হিমবাহের এক-তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। উষ্ণায়নের পাশাপাশি কল-কারখানা, যানবাহন, কাঠ-কয়লা পোড়ানোর ছাই এবং বাতাসের ধুলো গিয়ে আস্তরণ ফেলছে। ফলে হিমবাহের সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাপ শোষণের অভাবে আবহাওয়ায় তাপমাত্রা বাড়ছে। বৃষ্টিপাতের সময় ও গতিপ্রকৃতিতে তারতম্য ঘটে যাওয়ায় তুষারপাত অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। ফলে হিমবাহ আরও দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
হিমালয়ের পরিস্থিতি আরও সংকটজনক। ভারতের উত্তর জুড়ে থাকা প্রায় ১০ হাজার হিমবাহ বছরে গড়ে আধ থেকে এক মিটার করে গলছে। সাম্প্রতিক দশকে কোথাও কোথাও বছরে এই মাত্রাটা ২০ থেকে ৩০ মিটার। এই প্রায় দশ হাজারের মধ্যে উত্তরাখণ্ডেই ৯০০ হিমবাহের অবস্থান। অতি গুরুত্বপূর্ণ গঙ্গোত্রী হিমবাহ বছরে ১৫ থেকে ২০ মিটার ক্ষয়ে যাচ্ছে। সতোপন্থ, ভাগীরথী, রাইখানার মতো হিমবাহও যথেষ্ট বিপদগ্রস্ত। বরফ গলে-গলে সিকিমের দক্ষিণ লোনাক হিমবাহ ১৯৬২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ৩ কিলোমিটার পিছিয়ে গিয়েছে। আয়তনে বাড়তে থেকেছে দক্ষিণ লোনাক লেক। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে হ্রদের মোরেইন বা নুড়ি-পাথরের দেওয়াল আর জলের বিশাল ওজনের চাপ সামলাতে পারেনি। আরও একবার ঘটেছে ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ বা ‘জিএলওএফ’ অর্থাৎ হিমবাহ-সৃষ্ট হ্রদ ছাপিয়ে বন্যার ঘটনা। তাতে অন্তত ৯০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ‘তিস্তা ৩’ ড্যাম। গ্রাম-শহর, রাস্তা, ব্রিজ ধুয়েমুছে গিয়েছিল। চরম দুর্বিপাকে পড়েছিলেন ৮০ হাজার মানুষ। ৬ হাজার প্রাণ কেড়ে নেওয়া কেদারনাথ ট্র্যাজেডির কারণটাও সেই একই– জিএলওএফ, হিমবাহ-পুষ্ট চোরাবারিতাল হ্রদের পাড় ভেঙে বিধ্বংসী বন্যা। এক্ষেত্রে সঙ্গে যোগ হয়েছিল মেঘভাঙা বৃষ্টি।
হিমবাহ গলে হ্রদ এলাকা ভাসিয়ে দিলে প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসাবে জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়, প্রাণহানি হয়। সেটা চোখে ঠেকে। আর বিশ্বজুড়ে হিমবাহের সংকুচিত হয়ে আসা পরোক্ষে সভ্যতার কী কী অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছে, সেই ব্যাপারে আমরা খুবই কম ওয়াকিবহাল। তাই, কবে একটা ধারালি বা কেদারনাথ-কাণ্ড ঘটছে তাতে না যথেষ্ট আমল দেওয়া হয়, না-ই পুনরাবৃত্তি রুখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
হিমবাহ দ্রুত গলতে থাকায় গঙ্গা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-সহ সমস্ত বরফগলা জলে পুষ্ট নদীতে প্রবাহ বেড়ে গিয়ে বন্যার মাত্রা বেড়েছে। আবার উলটো পিঠের সত্যিও আশঙ্কাজনক। হিমালয়ের হিমবাহে পুষ্ট নদীর জলেও উপর ভারতের একটা বিরাট অংশের বাসিন্দার জীবনযাপন নির্ভর করে। হিমবাহ কমে আসতে থাকলে, জলের পরিমাণও কমবে। দেখা দেবে পানীয় জলের অভাব। দেশের চাষবাসের ৬০ শতাংশ নদী-সেচের উপর নির্ভরশীল। সেচ না-পেলে চাষের ক্ষতি হবে। খাদ্যাভাবে ভুগবে দেশ। আর্থ-সামাজিক প্রভাব পড়বে দেশের মানুষের উপর। ভারতে যত জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার ২০ শতাংশ নির্ভর করে হিমালয় থেকে নির্গত নদীর উপর। হিমবাহ হারিয়ে গেলে জলবিদ্যুতের অস্তিত্বও সংকটে পড়বে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে অরুণাচল পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার ধরে জুড়ে থাকা বিস্তীর্ন এলাকার বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র। বহু প্রাণী বিপন্ন হয়ে পড়বে, তৃণভূমির অভাবে রুজি হারাবে পশুপালকরা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন। এলাকার অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়বে।
মেরু এলাকার হিমবাহ গলে গিয়ে পৃথিবীর সমুদ্রস্তর বাড়িয়ে তুলছে। হিমালয়ের ক্ষয়িষ্ণু হিমবাহ সুন্দরবন বা মুম্বইয়ের মতো নিচু উপকূলীয় এলাকাকে অস্তিত্ব-সংকটে ফেলে দেবে। তথ্যনির্ভর সমীক্ষা সাবধানবাণী শুনিয়েছে, হিন্দুকুশ হিমালয় এলাকায় প্রাক-শিল্পযুগ থেকে এখনও পর্যন্ত ৪০ শতাংশ হিমবাহের অপমৃত্যু ঘটেছে। দূষণের যেরকম অবাধ গতিপ্রকৃতি তাতে আগামী শতাব্দীর মধ্যে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ হিমবাহ হারিয়ে যেতে পারে। তাতে স্রেফ হিমালয় নয়, দেশ বিপন্ন হতে পারে। তাই, বন্যার রূপে হিমবাহের শোনানো একের-পর-এক সতর্কবাণী কানে না-তোলা, অতি জরুরি পদক্ষেপ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার প্রবণতা অবিলম্বে ছাড়তে হবে। পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিতে হবে এই সমস্যার সমাধানে।
হিমবাহ গলে যাওয়ার মূল যে-দু’টি কারণ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং হিমালয়ের প্রাকৃতিক স্থিতিকে বেহিসেবি ‘উন্নয়ন’-এর শিকল থেকে মুক্ত করা– দু’টির সমাধান করা সহজ নয়। আবহাওয়ায় ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা রুখতে কয়লা, পেট্রোল, ডিজেলের মতো জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সোলার, উইন্ডমিল এবং জলবিদ্যুতের মতো রিনিউয়েবল এনার্জির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তবেই বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা কমবে। কলকারখানা-যানবাহন, সর্বত্রই এমন প্রযুক্তির প্রবর্তন করতে হবে যাতে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। দূষণ ও গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সঙ্গে যুদ্ধটা এলাকা বা দেশভিত্তিক নয়, হতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। গত মে মাসের
১৬ থেকে ১৮ তারিখ কাঠমান্ডুতে ২৪টি দেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক হিমবাহ সংরক্ষণ বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ‘সাগরমাথা সংবাদ’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের বিষয় ছিল, ‘জলবায়ু পরিবর্তন,
পর্বত এবং মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ’। এমন সম্মেলনের আরও প্রয়োজন রয়েছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী ভূপেন্দর সিং যাদব সেখানে হিমবাহের সংকট ও হিমালয়ের বিপন্নতা মেনে নিয়ে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রুখতে হিমবাহ-সৃষ্ট হ্রদের গতিপ্রকৃতির উপর লাগাতর নজরদারি এবং ‘জিএলএফ’-এর আগাম সতর্কবার্তা জারির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে হিমালয়ে পরিবেশ-বান্ধব পরিকাঠামোর উপর জোর দেওয়া হবে।
কিন্তু নিছক আলোচনায় বা সিদ্ধান্তে, ফসল ফলে না। সমস্যার সমাধান হয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মধ্য দিয়ে। হিমবাহ সভ্যতার অভিভাবক। তাদের বঁাচিয়ে রাখতে হবে, পৃথিবীকে বঁাচিয়ে নিজে বঁাচার জন্য।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.