বলা নেই কওয়া নেই, কাউকে কিছু বুঝতে না-দিয়ে হুট করে অমিত শাহ যে-বিল পেশ করলেন, তাতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী বা চুনো মন্ত্রীদের পর্যন্ত বরখাস্ত করা যাবে– যদি তাঁরা কোনও অভিযোগে টানা ৩০ দিন জেলে থাকেন। কিন্তু এটি কি স্রেফ মুখের কথা হয়ে থেকে যাবে না? বিলটি দিনের আলোর মুখ দেখবে আদৌ? সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে-প্রশ্ন উঠেছে, কিংবা নির্বাচন কমিশন বিজেপির
শাখা সংগঠনে পরিণত হয়েছে বলে যে-মারাত্মক অভিযোগ বিরোধীরা করে চলেছেন, তার
জন্য কমিশনই দায়ী। রাহুল গান্ধীর তোলা অভিযোগগুলির উত্তর জ্ঞানেশ কুমার দেওয়ার কোনও গরজ দেখালেন না। উল্টে যেভাবে রাহুলকে শপথ নিয়ে হলফনামা পেশের নিদান দিলেন, না-হলে ক্ষমা চাইতে বললেন ও তার মধ্য দিয়ে প্রতিটি প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন, তাতে
সন্দেহ আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে কমিশনের হাল– ফাটা বাঁশে বাঁদরের লেজ আটকে যাওয়ার মতো।
হঠাৎই দেশের সাংবিধানিক পদের কর্তাদের অসম্মানিত হওয়ার হিড়িক পড়েছে যেন!
উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের পর নির্বাচন কমিশন। এরপর আরও কী-কী হতে পারে
ভগবান ঈশ্বর এবং মোদি-শাহ জুটিই জানেন। বিরোধীদের উপ-রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী প্রাক্তন বিচারপতি বি. সুদর্শন রেড্ডিকে তো অমিত শাহ ইতিমধ্যেই নকশালপন্থীদের ‘সমর্থক’ দাগিয়ে দিয়েছেন। বিনাশকালে অথবা জ্ঞানগম্যি হারালে হয়তো এমনই দশা হয়।
জ্ঞানেশ কুমারের আচরণে কমিশনের একাধিক প্রাক্তন কর্তা হতবাক। এস. ওয়াই. কুরেশি,
ও. পি. রাওয়াত কিংবা অশোক লাভাসাদের বিস্ময়, যেখানে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে বিতর্কে জল ঢালা যেত, সেখানে জ্ঞানেশ কুমার কেন গাজোয়ারি মনোভাব দেখালেন? কেন এমন অহেতুক গোঁ? প্রত্যেকেই মনে করছেন, এই গোঁয়ার্তুমি কমিশনকেই কাঠগড়ায় দঁাড় করিয়েছে।
সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। বোঝাচ্ছে, গুরুতর কিছু তারা আড়াল করতে চাইছে। মানুষ মনে করছে, রাহুলের অভিযোগগুলো নিছক মনগড়া নয়। আগে সুনীল অরোরা ও রাজীব কুমার
টিম বিজেপির হয়ে ব্যাট করেছেন, জ্ঞানেশ কুমারও সেই টিমের ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিরোধীরা যখন এককাট্টা, রাহুল-তেজস্বীদের ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ ঘিরে বিহার উত্তাল, ঠিক তখন লোকসভায় সরকারের পেশ করা ১৩০তম সংবিধান সংশোধন বিল এক অন্য বিস্ময়। বলা নেই কওয়া নেই, কাউকে কিছু বুঝতে না-দিয়ে হুট করে অমিত শাহ যে-বিল পেশ করলেন, তাতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী বা চুনো মন্ত্রীদের পর্যন্ত বরখাস্ত করা যাবে যদি তঁারা কোনও অভিযোগে টানা ৩০ দিন জেলে থাকেন।
বিল পেশের সময় লোকসভায় যে-দৃশ্যপট সৃষ্টি হয়েছিল, বিলের কপি ছিড়ে অমিত শাহর মুখের উপর উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা অবাক করার মতোই ঘটনা। এটাও অবশ্য অবাক করার মতোই যে, এমন একটা বিল আনার আগে সরকার কারও সঙ্গে আলোচনা করল না! কারও মত নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করল না! প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চাইলেন, রাজনীতিকে অপরাধী-মুক্ত করে তুলতে তাঁর তাগিদ কী তীব্র! বিল পেশের সময় অমিত শাহ এ-কথাও গর্ব করে শোনালেন, বিলের খসড়ায় প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে মোদি নিজেই আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, তাঁকেও, মানে প্রধানমন্ত্রীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এতটাই ব্যতিক্রমী তিনি।
১১ বছর ধরে চমকের যে-রাজনীতি জনতা দেখে আসছে, এই বিল তার সর্বশেষ সংযোজন। মোদি-জমানায় চমক অবশ্য অন্তহীন। একটার রেশ কাটতে-না-কাটতেই পরের চমকে মানুষ চমৎকৃত হয়েছে। বারবার। নোটবন্দি ছিল ‘কালো টাকা’ ভ্যানিস হয়ে সাদা করার চমক। পাচার হওয়া কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আম আদমির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখি ঝনঝনানির চমক মানুষকে মোহাবিষ্ট করেছিল। কালো টাকা ‘সাদা’ হওয়ায় সন্ত্রাসীদের অর্থের জোগান বন্ধ হওয়ার গল্প শুনে মানুষ নিশ্চিন্ত বোধ করেছে। বুঝেছে, এরপরও সন্ত্রাসী হামলা হলে সেটা সরকার-বিরোধী চক্রান্ত। ফি-বছর নিয়ম করে দু’-কোটি বেকারের চাকরি হওয়ার চমকে বেকারেরা মজেছে। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হওয়ার চমকে গ্রামকে গ্রাম ‘বল্লে বল্লে’।
‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’-র চমকে আমজনতা অভিভূত! দেশ এখন দুর্নীতিমুক্ত! ডাব্ল ইঞ্জিন সরকারের রাজত্বে উন্নয়নের জোয়ার চিরন্তন। ভাটা নেই। বিশ্বগুরুর নেতৃত্বে পৃথিবী উঠছে-বসছে। চমৎকৃত বিশ্ব। এবার থেকে দেশের কোনও মন্ত্রী, তা তিনি প্রধান হোন, মুখ্য হোন কিংবা অমুখ্য, জেলের গরাদের মধ্যে বসে সরকারি ফাইলে সই করতে পারবেন না। নরেন্দ্র মোদি বুক বাজিয়ে তা বলে বেড়াচ্ছেন। লেটেস্ট চমক এটাই।
বলছেন বটে, কিন্তু নিজেও জানেন, স্রেফ মুখের কথা হয়ে থাকবে এটাও। বিলটি দিনের আলোর মুখ দেখবে না। এতটা জোর দিয়ে কথাটা বলা যাচ্ছে– যেহেতু লোকসভা বা রাজ্যসভা কোথাও মোদি সরকার সংবিধান সংশোধন বিল পাসের জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাবে না। সংগত প্রশ্ন, তাহলে কেন বিলটা আনা হল? উত্তরটা রয়েছে ওই চমকের রাজনীতিতে। নিজের উপর নরেন্দ্র মোদির বিশ্বাস এখনও এতটাই দৃঢ় যে, তিনি মনে করেন, যা কিছু তিনি বলেন দেশবাসী তা বেদবাক্য মনে করে।
প্রচারে তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো কেউ ভূ-ভারতে নেই। রাজনীতিকে অপরাধ ও অপরাধী-মুক্ত করতে এই যে কাজটা তিনি করতে চাইছেন বিরোধীরা তা হতে দিতে চায় না, এই কথাটাই তিনি প্রচার করে যাবেন। মানুষ তা বিশ্বাস করবে। আবার তাঁর ডাকে সাড়া দেবে। বিহারে ফের কায়েম করবে তাঁর রাজত্ব। বছর-শেষে বিহার জিতে পরের বছর নতুন উদ্যমে শুরু করবেন পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুকে ‘মাছের চোখ’ করে।
কোনওভাবে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেলেও আইনি ব্যাখ্যায় বিলটি আটকে যেতে বাধ্য। ন্যায়বিচারের একটি ধাপও টপকাতে পারবে না। তবু সেই পথে হঁাটা এটাই বোঝায়, মোদি সরকার দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। ভয় দেখিয়ে তটস্থ করে রাজত্ব করা-ই শাসকের লক্ষ্য। মামলার ভয় ও ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি বিরোধীদের কীভাবে কুঁকড়ে রাখে, ১১ বছরে তার প্রমাণ চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ইডি, সিবিআই লেলিয়ে মুখ বন্ধ রাখার বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে বিরোধীরা যে-মামলা করেছিল, তাতে দেখানো হয়, ২০১৪ থেকে১০ বছরে ৯৫ শতাংশ মামলার ‘লক্ষ্য’ ছিল শুধু বিরোধীরাই।
‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস’-এর (এডিআর) হিসাব দেখাচ্ছে, ২০১৪ সালে ১৮৬ জন সাংসদের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ, ধর্ষণের মতো গুরুতর ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছিল। এঁদের মধ্যে বিজেপির সদস্য ছিলেন ৯৮ জন। ২০১৯ সালে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ২৩৩, পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালে ২৫১। ১১ বছরে যিনি রাজনীতিকে অপরাধী-মুক্ত করতে কুটোটি পর্যন্ত নাড়েননি, এখন হঠাৎ কেন এত নড়েচড়ে বসা? উত্তরটা রয়েছে ওই চমক ও ব্ল্যাকমেলের রাজনীতিতে।
নরেন্দ্র মোদির চমকের রাজনীতির একটুকরো নমুনা পেশ করেছেন একদা ভোটকুশলী এখন রাজনীতিক প্রশান্ত কিশোর (পিকে)। তিনি দল গড়েছেন– ‘জন সুরজ পার্টি’। বিহার বিধানসভার ভোটে লড়বেন। সেদিন ‘এএনআই’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোদির গিমিকের গল্প শোনালেন পিকে। গল্পটা ২০১৪ সালের। পিকের দাবি, সেবার মোদির প্রচারের ভাষণ ছিল তাঁরই লেখা। সেই ভাষণে বিহারের মোতিহারিতে একটি চিনি মিল খোলার প্রতিশ্রুতি ছিল। মোদি বলেছিলেন, চিনি মিলে তৈরি চিনি দিয়ে চা না-খাওয়া পর্যন্ত তিনি বিহারে ঢুকবেন না। ভোট চাইবেন না। পিকে-র কথায়, ‘চিনি মিলের জমি বিক্রিবাটা হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ প্লট কিনেছেন বিজেপি নেতারাই। মোদিও প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলেছেন। যদিও মোতিহারিতে তিনি আরও চারবার গিয়েছেন!’
বিহারে এবার অন্য চ্যালেঞ্জ। মহারাষ্ট্রের মতো বিহারেও কমিশন মুশকিল আসান না-হলে, ‘এসআইআর’-এ ধরা খেলে, ৭৫ পেরনো মোদির সংকট বাড়বে। বাঁচতে হলে দরকার নতুন কাহিনি। নতুন গিমিক। নতুন স্বপ্নের ফেরি। জেলবন্দি মন্ত্রীদের চাকরি খাওয়া নতুন চমক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.