জেলেনস্কিকে কার্যত অন্ধকারে রেখে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের সঙ্গে ‘শান্তি বৈঠকে’র সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের। সব ঠিক থাকলে ১৫ আগস্ট শুক্রবার আলাস্কায় হবে সেই ‘হাই ফ্রোফাইল’ এবং ‘হাই ভোল্টেজ’ বৈঠক। প্রশ্ন উঠছে, ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক কি ইতিহাসের বিপজ্জনক পুনরাবৃত্তি? বিশ্বগ্রামের মোড়ল সেজে খাপ পঞ্চায়েত বসাতে চাইছেন ‘পাগলা রাজা’? লিখছেন কিশোর ঘোষ।
বর্তমান বিশ্বের নিয়ন্ত্রক কে? যুদ্ধ না অর্থনীতি? গত এক দশকে গুলিয়ে যাচ্ছে অঙ্ক। ‘বারুদবোমা’ আর ‘ডলারস্ত্রে’ একসঙ্গে শান দিচ্ছে অক্ষশক্তিগুলি। তারই ফল ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর মার্কিন বেয়াদপি। যার পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের দুই মন্ত্রী রাজনাথ সিং আর নীতিন গড়করি সত্যিটা বলেই ফেলেছেন। খোঁচা দিয়ে আমেরিকাকে ‘সব কা বস’ সম্বোধন করেন রাজনাথ, অন্যদিকে গড়করি ওয়াশিংটনের ‘দাদাগিরি’ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। যদিও উষ্মাই সার! ‘নোবেল খেপা’ ধনকুবের মার্কিন প্রেসিডেন্টের তাতে যে কিছু যায়-আসে না, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন জেলেনস্কিকে কার্যত অন্ধকারে রেখে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের সঙ্গে তাঁর ‘শান্তি বৈঠকে’র সিদ্ধান্তে। সব ঠিক থাকলে ১৫ আগস্ট শুক্রবার আলাস্কায় হবে সেই ‘হাই ফ্রোফাইল’ এবং ‘হাই ভোল্টেজ’ বৈঠক। প্রশ্ন উঠছে, ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের এই সিদ্ধান্ত কি ইতিহাসের বিপজ্জনক পুনরাবৃত্তি? বিশ্বগ্রামের মোড়ল সেজে খাপ পঞ্চায়েত বসাতে চাইছেন ‘পাগলা রাজা’?
উত্তর পেতে টাইম মেশিনে চাপতে হবে আমাদের। পিছোতে হবে ৮৭ বছর। সেটা ১৯৩৮ সাল। ৩০ সেপ্টেম্বর। জার্মানির মিউনিখ শহরে বিতর্কিত ‘শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষর করে হিটলারের জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইটালি। এই চুক্তি হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়ার উপর জার্মান আগ্রাসন নিয়ে (আজকে যেমন রাশিয়ার আগ্রাসনে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন)। অথচ চেকদের মতামত গ্রাহ্য হয়নি। মিউনিখ চুক্তি অনুযায়ী চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মান সীমান্তবর্তী সুডেটেনল্যান্ড দখল করে নাৎসি জার্মানি। যুক্তি ছিল ওই অঞ্চলের বসবাসকারী ত্রিশ লক্ষ মানুষ জাতিগত ভাবে জার্মান। আদতে যুদ্ধের বারুদে গোটা ইউরোপ জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম ভিলেন হিটলার। যার পরে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে চেকোস্লোভাকিয়াকে বলির পাঁঠা বানানো হয়। চেকদের মতামতের পরোয়া না করে তৎকালীন ‘সব কা বস’ জার্মানির করকমলে তুলে দেওয়া হয় সুডেটেনল্যান্ডকে। বলা বাহুল্য, এই চুক্তিতে চেকদের রাজি হওয়ার কারণ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রবল কূটনৈতিক চাপ। এই কারণেই ‘মিউনিখ চুক্তি’র অপর নাম ‘মিউনিখ বিশ্বাসঘাতকতা’। পৃথিবী গোল! ৮৭ বছর পর নয়া বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি ইউক্রেন?
আগামী শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি ট্রাম্প নিজেই প্রকাশ্যে আনেন। তিনি ট্রুথ সোশালে লেখেন, “অবশেষে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও আমার বৈঠকটি হতে চলেছে। আগামী শুক্রবার ১৫ আগস্ট আলাস্কায় আমাদের সাক্ষাৎ হবে।” পরে টেলিগ্রামে রাশিয়ার তরফে এক বিবৃতিতেও জানিয়ে দেওয়া হয়, “প্রেসিডেন্টরা নিঃসন্দেহে ইউক্রেন সংকট নিয়ে আলোচনা করবেন, দীর্ঘকালীন শান্তি চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।” যদিও ‘আলাস্কা বৈঠকে’ খোদ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ঠাঁই পাচ্ছেন না বলেই খবর। তারচেয়েও আশঙ্কার কথা, ‘আলাস্কা ডিলে’ ইউক্রেনের ডোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপরজাই এবং খেরসনের মতো ভূখণ্ডগুলি আনুষ্ঠানিক ভাবে রাশিয়ার দখলে চলে যেতে পারে। সম্ভবত সেই শর্তেই যুদ্ধে খান্ত দিতে রাজি হতে পারেন পুতিন।
অর্থাৎ ঠিক যেন ১৯৩৮-এর মিউনিখ চুক্তি। কেবল চেকোস্লোভিকিয়ার জায়গায় এবার ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে রাশিয়া ও আমেরিকা। জেলেনস্কি কি মেনে নেবেন স্বাধীকার ভঙ্গের এই ষড়যন্ত্রকে? সবচেয়ে বড় কথা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালির মতো ইউরোপের শক্তিগুলির মতামতের পরোয়া না করেই আলাস্কায় বৈঠকে বসতে চলেছেন পুতিন-ট্রাম্প। এতে লাভ কার? প্রথমত, লাভবান হবেন পুতিন। ২০২২-এর আগেই ইউক্রেনের ৪২ হাজার কিলোমিটার ভূভাগ দখল করেছিল মস্কো। তা আর ফিরিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। দ্বিতীয়ত, শান্তির মসিহা হওয়ার সাধপূরণ হবে ট্রাম্পের। চাই কি নোবেলটাও জুটে যেতে পারে এবার। পাশাপাশি চিনের ভ্রুকুটির মধ্যে মজবুত হবে আমেরিকা-রাশিয়া বন্ধুত্ব। খাপ পঞ্চায়েত তো কখন দুর্বল, গরিবের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবে না। অতএব, যে অন্ধকারে ছিল ইউক্রেন, সেই অন্ধকারেই পড়ে থাকবে তারা। এবং যুদ্ধ ও অর্থনীতির বিপজ্জনক ঘূর্ণিপাকে আরও বেশি করে তলিয়ে যাবে সবুজনীল এই গ্রহ। বেঘোরে মারা যাবে বিশ্বশান্তি!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.