লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ‘ব্ল্যাক মিউজিয়াম’। এই মিউজিয়ামের কিউরেটর বিল ওয়াড্ডেল ১৯৯৩ সালে মিউজিয়ামে রক্ষিত সমস্ত স্মারকদ্রব্যের খুঁটিনাটি ইতিহাস সংগ্রহ করে লেখেন ‘The Black Museum: New Scotland Yard’ বইটি। ঘৃণ্য থেকে অতি ঘৃণ্য অপরাধের স্মারক-ঘর এই ক্রাইম মিউজিয়ামটি। মানুষের চূড়ান্ত নৃশংসতার নজিরক্ষেত্রও। লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক।
বইয়ের পাতাগুলো কাটা হয়েছিল ঠিক একটা পিস্তলের মাপে। সেখানে পিস্তল ভরে লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে ঢুকে গেলেন রাম মহম্মদ সিং আজাদ, বসে পড়লেন ফঁাকা একটা আসনে। সেখানে সভা শেষ হওয়ামাত্র বইয়ের ভিতর লুকোনো খোপ থেকে বের করে আনলেন পিস্তল আর মাইকেল ও’ডায়ার-কে লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলেন গুলি। ও’ডায়ারের হৃৎপিণ্ড আর ডান ফুসফুস ভেদ করে বেরিয়ে গেল সে-গুলি আর সেখানেই লুটিয়ে পড়লেন পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূল চক্রী কুখ্যাত ও’ডায়ার। মধুর প্রতিশোধ নিলেন ‘রাম মহম্মদ সিং আজাদ’ ওরফে উধম সিং। বাজেয়াপ্ত হল সেই পিস্তল, কয়েক দিন আগে লন্ডনের এক পাব-এ যা এক সৈনিকের থেকে কিনেছিলেন উধম সিং। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই অসামান্য স্মারকটি যদি দেখতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ব্ল্যাক মিউজিয়ামে, সেখানেই যথাযথভাবে রক্ষিত আছে উধম সিংয়ের পিস্তল।
তবে উধম সিংয়ের পিস্তল দেখে আপনার মন ভরে গেলেও সেই জাদুঘরে আর যেসব জিনিস রাখা আছে, তা দেখে আপনি ভিতরে ভিতরে হয়তো শিউরে উঠতে পারেন। যেমন, আপনার চোখ পড়তে পারে মামুলি একটা টিন-ওপেনারের উপর। একটু খোঁজখবর করলে জানতে পারবেন এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য বহন করছে এই টিন-ওপেনার। ১৯৪২ সাল নাগাদ বিশ্বযুদ্ধের ফলে জারি করা ব্ল্যাক-আউটের সময় জনৈক গর্ডন কামিন্স ছ’দিনে চারজন মহিলাকে খুন করে এবং দু’জনের খুনের চেষ্টা চালায়। এই চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন ইভলিন ওট্লে। নিজের ফ্ল্যাটের বিছানায় তঁাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সারা শরীর জুড়ে অজস্র গভীর ক্ষত। শুধু যৌনদ্বারে রয়েছে ছ’টি লম্বালম্বি কাটা ক্ষত, যেন ওপেনার দিয়ে গোটা শরীর থেকে কেউ তুলে নিতে চেয়েছিল যোনিটুকু।
নয়ের দশকে এই মিউজিয়ামের কিউরেটর ছিলেন বিল ওয়াড্ডেল। তিনি ১৯৯৩ সালে মিউজিয়ামে রক্ষিত সমস্ত স্মারকদ্রব্যের খুঁটিনাটি ইতিহাস সংগ্রহ করে লেখেন– ‘The Black Museum: New Scotland Yard’ বইটি। পৃথিবীর নানা দেশে এই ধরনের জাদুঘর থাকলেও সাধারণভাবে ‘ক্রাইম মিউজিয়াম’ বলতে প্রথমে এই ব্ল্যাক মিউজিয়ামের কথাই মনে আসে। তবে আগে এই ধরনের জিনিস জমা থাকত রাজপরিবারের কাছে। পরে ১৮৭৪ সাল নাগাদ ইনস্পেক্টর পারসি জর্জ নিয়েম কিছু স্মারক জোগাড় করেন মূলত শিক্ষানবিশ পুলিশ অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য। এই থেকেই প্রথমে তঁার মাথায় আসে এমন একটি মিউজিয়াম তৈরির কথা। ১৮৭১ সালে খুন হওয়া ১৭ বছরের জেন মারিয়া ক্লোউসনের মৃতদেহর পাশ থেকে পাওয়া রক্তমাখা হাতুড়ি আর পোশাক সংরক্ষণ দিয়েই শুরু হয়েছিল এই জাদুঘরের প্রথম পদক্ষেপ। ১৮৭৫ সালে এই জাদুঘর খুলে দেওয়া হয়। এখন প্রায় হাজারখানেক স্মারক দ্রব্য এখানে রাখা আছে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় (১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) বন্দি করে। দুই বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার এবং আবার ১৯৬৭ সালে নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় আর-একবার এই ব্ল্যাক মিউজিয়াম কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। ছাতার ভিতরে লুকোনো বন্দুক কিংবা নির্বিষ ছড়ির মধ্যে রাখা তলোয়ারও যেমন এখানে রাখা আছে খুনের অস্ত্র হিসাবে, তেমনই আছে অপরাধীকে ফঁাসি দেওয়া বেশ কয়েকটি কাছিদড়ির ফঁাস, অপরাধীদের মুখের ছাপ তোলা অনেকগুলো ডেথ মাস্ক, চিঠিপত্র ইত্যাদি।
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যেমন একবার চার্লস পিস নামে এক ১৪ বছরের বালক দুর্ঘটনায় চিরকালের জন্য হারায় তার একটি পা। কিছু দিন বাদেই ম্যানচেস্টারের এক পুলিশকে খুন করে পালিয়ে যায় সে। কুখ্যাত তস্কর এবং খুনি এই চার্লসের ভঁাজ করে রাখা মই, নকল হাত, সুদৃশ্য কেস-সমেত বেহালা সবই চলে আসে ব্ল্যাক মিউজিয়ামে। সংরক্ষিত রয়েছে একটি বিষের বাক্সও, যার মালিক ডাক্তার টমাস নেইল ক্রিম। তিনটি দেশের দশ মহিলাকে তিনি স্ট্রিকনিন দিয়ে হত্যা করেন। নিম্নবিত্ত, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদেরই তিনি নিশানা করতেন। তঁার এই হত্যালীলা শেষ হয় ১৮৯২ সালে, ফঁাসি হয় ডাক্তারের।
মিউজিয়ামের দর্শকদের চোখে এখনও পড়ে মামুলি একটি জুতো। এখন হয়তো আর বোঝাও যাবে না যে, ৮৫ বছর আগে থেকে এই জুতোয় লেগে আছে অ্যালান জি-র রক্ত। এই জুতোর মালিক ফ্রান্সিস ফোরসিথ– বিশ শতকের ব্রিটেনে সবচেয়ে কম বয়সে ফঁাসি হয়ে যাওয়া এক কিশোর অপরাধী। ফঁাসির সময়ে তার বয়স ছিল ১৮ বছর ৭ মাস। যদিও ১১ বছর বয়স থেকেই অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং সে আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা অ্যালান-কে আক্রমণ করে জুতো দিয়ে মারতে মারতে যখন মেরেই ফেলে, তখনও কিন্তু সে আসলে কিছু দিনের জন্য ছাড়া পেয়েছিল জামিনে। ফোরসিথের পায়ে ছিল ‘ইউঙ্কিল-পিকারস’ জুতো, ১৯৫০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ রক অ্যান্ড রোলপ্রেমীদের পায়ে-পায়ে যা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। জুতোর সামনের অংশ ছিল অস্বাভাবিক লম্বা এবং ছুরির মতো সরু আর তীক্ষ্ণ। জুতোয় লেগেছিল অ্যালানের রক্তের দাগ। সেই রক্তমাখা জুতো এখনও আছে এক ভয়াবহ কিশোর অপরাধীর স্মারকচিহ্ন হিসাবে।
এবার বুলগেরিয়ান আমব্রেলা-র গল্প বলি। বুলগেরিয়ান আমব্রেলা কিন্তু বুলগেরিয়ায় তৈরি হওয়া কোনও সাধারণ ছাতা নয়। বুলগেরিয়ার লেখক গিয়র্গি মারকভ (১৯২৯-১৯৭৮) ৪০ বছর বয়সে দেশ ত্যাগ করে চলে আসেন লন্ডনে, কাজ নেন বিবিসি-তে। লন্ডনের রাস্তায় একদিন তিনি হঁাটছেন, হঠাৎ তঁার পায়ে যেন একটা খোঁচা লাগল, তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন একজন লোক ক্ষমা চেয়ে তঁার হাতের ছাতাটা নামিয়ে নিলেন। খুবই সাধারণ ঘটনা, কিন্তু এর চারদিনের মাথায় মারা গেলেন মারকভ। আসলে এই ছাতার মধ্যে ছিল রাইসিন বিষে ভরা ১.৭০ মিলিমিটারের ছোট্ট একটি পেলেট বা গুলি, ছাতা থেকে সেই গুলি ছিটকে এসে ঢুকে গিয়েছিল মারকভের পায়ে। মারকভের উপর এই আক্রমণের দিন দশেক আগে পারি শহরেই আর-এক বুলগেরিয়ান ভ্লাদিমির কোসটোভ-কে ঠিক একই উপায়ে মেরে ফেলার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। পরে জানা যায়, মারকভ হত্যাকাণ্ডের পিছনে রয়েছে ‘বুলগেরিয়ান সিক্রেট সার্ভিস’ এবং রাশিয়ার ‘কেজিবি’। বুলগেরিয়ার বিশেষ ছাতাটি দেখতে চাইলে আপনাকে যেতেই হবে ব্ল্যাক মিউজিয়ামে।
বড় সসপ্যান আর স্টোভ, লোহার ট্রাঙ্ক আর তামাকের বাক্স– মানব সভ্যতার অকিঞ্চিৎকর এসব তৈজসপত্র আপনার মনোযোগ একেবারেই আকর্ষণ করবে না, যদি না আপনি বিল ওয়াড্ডেলের লেখা থেকে জানতে পেরে থাকেন এগুলির মাহাত্ম্য! স্কটিশ সিরিয়াল কিলার ডেনিস নিলসেন ব্যবহার করতেন এই স্টোভ আর সসপ্যান। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত যে-বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেখানে নানা কায়দায় নিয়ে আসতেন নতুন-নতুন লোককে, তারপর খুন করতেন। প্রত্যেকটা খুনের পর মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ কেটে সেদ্ধ করতেন এই সসপ্যানে। সেই সসপ্যানই রাখা আছে রীতিমতো সাজিয়ে! আর লোহার ট্রাঙ্কটির মালিক ছিলেন জন রবিনসন। ১৯২৭ সালের মে মাসের ছয় তারিখে একটা ট্যাক্সি চেপে চেরিং ক্রশ রেলস্টেশনে এসে বছর পঁয়ত্রিশের এই রবিনসন-ই ‘লেফট-লাগেজ অফিস’-এ জমা দিয়ে গিয়েছিলেন ওই লোহার ট্রাঙ্ক। কিছুদিন পর যখন সেই ট্রাঙ্ক থেকে পচা গন্ধ বেরতে লাগল, খোলা হল সেই ট্রাঙ্কের ডালা। দেখা গেল, কোনও এক মহিলার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে আলাদা-আলাদা করে ব্রাউন পেপারে মুড়ে রাখা আছে ট্রাঙ্কের ভিতরে। কীভাবে জানা গেল এই মহিলার পরিচয় আর ধরা পড়ল খুনি রবিনসন, তা এক রোমহর্ষক কাহিনি, সে কাহিনিতে আমরা এখন ঢুকছি না। কিন্তু এই কালো রঙের ট্রাঙ্কটি রয়ে গিয়েছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কৃষ্ণ জাদুঘরে। সবচেয়ে সাধারণ দেখতে তামাকের বাক্সটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ভয়াবহতম অপরাধের অনুষঙ্গ। এই বাক্সটি যার, সেই সিরিয়াল কিলার এবং সিরিয়াল ধর্ষকের নাম জন ক্রিস্টি (১৮৯৯-১৯৫৩)। নিজের স্ত্রী-সহ অন্তত আরও দশজনকে তিনি হত্যা করেছিলেন বলে জানা গিয়েছিল পুলিশি প্রমাণ থেকে। কিন্তু পরে দেখা যায় আসল সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি। ক্রিস্টি-র ঘর থেকেই পাওয়া যায় এই গোল্ড লিফ টোব্যাকো বক্স যার মধ্যে ছিল নানা মহিলার গুচ্ছ গুচ্ছ যৌনকেশ, যেগুলি আসলে ছিল খুন আর ধর্ষণের এক-একটা ট্রফি।
আমরা জাদুঘরে যাই মানব সভ্যতার উন্মেষ এবং বিবর্তনের বিভিন্ন চিহ্ন দেখতে, সেই গৌরবের অংশ হতে। পৃথিবীর কত না-জানা অতীত আমাদের সামনে এসে দঁাড়ায়, আমরা আশ্চর্য হই, পুলকিত ও রোমাঞ্চিত হই, গর্ব অনুভব করি। কিন্তু বিল ওয়াড্ডেলের লেখা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এই ব্ল্যাক মিউজিয়াম নিয়ে বই একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় মানুষ আসলে ভয়ংকরতম প্রাণী, চূড়ান্ত নৃশংসতা মিশে আছে তার গোপন সত্তায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.