শঙ্করকুমার রায়, রায়গঞ্জ: মায়ের মন্দিরে ব্রাত্য মহিলারাই। প্রাচীন দেবী মায়ের গর্ভগৃহে কোনও মহিলার প্রবেশের অনুমতি নেই। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের বয়রা কালীপুজোর উপাচারে যাবতীয় উপকরণ থেকে অন্নভোগ আয়োজনে শুধুই পুরুষবাহিনী। এই পুজোর সব কিছুতেই ব্রাত্য মহিলারা।
কথিত আছে, রাইফেল হাতে উর্দিধারী সশস্ত্র পুলিশের ঘেরাটোপে শরতের ভোরে শ্রীমতি নদীর পাড়ে ঠাকুরদালানে দেবী কালিকা সারা অঙ্গ রাজকীয় স্বর্ণ অলঙ্কারে ঝলমলিয়ে জেগে ওঠেন। ইংরেজ আমলে শ্রীমতির বুকে নৌকা ভাসিয়ে মাছ ধরতে ধরতে ঘনজঙ্গলে বয়রা গাছের তলায় হেলায় পড়ে থাকা পাথরের বেদিকে মাতৃকাশক্তিরুপে দুর্বা আর ফুল বেলপাতা নিবেদন করে পুজোর পত্তন করেছিল তৎকালীন একদল মৎস্যজীবী। সুযোগ লুফে নিয়ে দুর্বৃত্তরা দুষ্কর্মে শক্তি লাভ করতে লুঠতরাজ করার আগে এই জলা জঙ্গলের বেদিকে পুজো করতেন। ওপারের বাংলাদেশ থেকে প্রবাহিত নদীর অদূরে ১৮৯৮ সাল নাগাদ ব্রিটিশ শাসনকালে অবিভক্ত দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার উলটোপাড়ে টিনচালা ঘরে মাটির প্রতিমায় নবরূপে কালীপুজোতে মেতে উঠেন নির্জন জনপদের হাতে গোনা জনা কয়েক বাসিন্দা।
কালের নিয়মে সময় বয়ে গিয়েছে। ১৯৬৮ সাল নাগাদ কংক্রিটের বয়রা কালীমাতা মন্দির নির্মিত হয়। কালিয়াগঞ্জের কালীপ্রতিমা মাত্র তিন দশক আগে ১৯৯৮ সালে কলকাতার প্রথিতযশা ভাস্কর্য মৃণাঙ্গ পালের সৃজনে অষ্টধাতুতে রূপান্তর হয়। দীপান্বিতার আলোয় আরাধনায় উত্তরের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে মায়ের মন্দিরের চাতালে। সারা বছর তিনবেলা পুজোর আরতিতে উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তের ভক্তদের ভক্তিতে মুখর দেবালয় প্রাঙ্গন। পাশ দিয়ে রহিত নদী নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে আজ সেই বয়রা গাছ। তবে দেবী কালীমাতার নামের মাহাত্ম্য নিয়ে নানা জনশ্রুতি, যদিও স্থানীয় একদল প্রবীণ ব্যক্তিত্বদের দাবি, ১৮৯৮ এর কালিয়াগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি নাজমুল হকের ভাই কানে বয়রা ছিলেন, তখন ভাইয়ের সুস্থতার জন্য পুলিশ দাদা নাজমুল কালীমাতার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। তাতে দেবীমায়ের স্বপ্নাদেশে ভাইয়ের কানের রোগ সেরে উঠে। সেই থেকে না কি ‘বয়রাকালী’ নামেই মুখে মুখে ভাসছে।
তবে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, গত চার বছর ধরে ভক্তদের বন্ধ ছাগবলি। তবে দেবীমায়ের চক্ষুদানের মাহেন্দ্রক্ষণে পরপর দু’টি পাঠা বলির ঐতিহ্য অটুট আজও। শুক্রবার পুজোর যুগ্ম সম্পাদক বিদ্যুৎবিকাশ ভদ্র বলেন, “মহেশ্বর শিবের পুজোর পর চণ্ডিপুজো তারপর রাত দেবী বয়রা কালীমাতার পুজো শুরু হয়। তবে রুই, কাতল, শোল, বোয়াল আর পুটি মাছ দিয়ে অন্নভোগ দেবীর চরণে নিবেদন করে দেবী রাজনন্দিনী মাতারূপে পুজো করা হয়। পাঁচরকম মাছের ব্যঞ্জন রান্না করেন ব্রাহ্মণ্যরা। সেইসঙ্গে লুচি-সুজি সহ রকমারি কাঁচা ফল তামার পরাতে সাজিয়ে দেবীমার কাছে নিবেদন করা হয়।”
বংশ পরম্পরায় পূজা অর্চনায় ছিলেন তারাপদ ভট্টাচার্য। তাঁর উত্তরসূরি সময় ভট্টাচার্য প্রায় ৩২ বছর ধরে মায়ের পূজারির ভূমিকায়। তাঁর কথায়, “মা পুজোর রাতে নির্জন পথে নুপূর পরে হেঁটে যান কয়েক মুহূর্ত। পুজোর পরের দিন সন্ধ্যায় দেবী অঙ্গের অলঙ্কার খুলে বাক্সবন্দি করে বন্দুক উঁচিয়ে পুলিশ পাহারায় কালিয়াগঞ্জ থানার লকার জমা রাখা হয়। পুজোর রাতে সব দলের নেতারা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যান।” স্থানীয় বাসিন্দা রায়গঞ্জের সাংসদ কার্তিকচন্দ্র পাল বলেন, “মা সকলের। তাই পুজোতে সকলে এক।” একই সুর কালিয়াগঞ্জ পুরচেয়ারম্যান তৃণমূলের রামনিবাস সাহার গলায়। তবে রীতি অনুযায়ী এবছর কালিয়াগঞ্জ থানার বর্তমান আইসি পদাধিকারী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় পুজো কমিটির সভাপতি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.